লেখক, অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। সাধারণত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি সচেতনতার চারাগাছ জন্ম নেয়। এরই পথ ধরে আগ্রহীদের যাত্রা শুরু হয় রাজনীতির রাজপথে। কিন্তু এম এম আকাশ ছিলেন এ বিষয়ে ব্যতিক্রম। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজনীতিতে যুক্ত হন। দুই বছরের মধ্যেই তিনি বামপন্থি রাজনীতির একজন রাজপথের কর্মী হিসেবে সক্রিয় অবদান রাখতে শুরু করেন। তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ছিলাম, আছি, থাকবো’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন রাজনীতির শুরু দিনগুলোর স্মৃতি। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭০ সালে যখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র তখন বিদ্যালয়গুলোতে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার একটি নতুন বই পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। বইটির নাম ‘পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি’। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই উত্তঙ্গ মুহূর্তে শাসক শ্রেণির এটা ছিল একটি নিষ্ফল প্রচেষ্টা’। তারা এই বইটি বাতিলের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল করেছিলেন। বইটি বাতিলের জন্য ‘স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল। সেই সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। এভাবেই রাজনীতির হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আগমন ঘটে তার।
এরপরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তিনি সেটিও রাজনীতিক কারণেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের অপরাজেয় বাংলার যে বটগাছটি রয়েছে, সেটি রোপণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। স্বাধীনতার আগেও এখানে একটি বটগাছ ছিল। এর গাছের নিচেই বিভিন্ন সভা ও জনসমাগম হতো। এই গাছের নিচে দাঁড়িয়েই ছাত্রনেতারা বক্তব্য দিতেন, নির্ধারণ করে দিতেন আন্দোলনের দিক। সেজন্য পাকিস্তানি শাসকদের কাছে বটগাছটি একটি চক্ষুশূলে পরিণত হয়। এ কারণে ২৫ মার্চ কালরাত্রির প্রথম অভিযানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই বটগাছটি উপড়ে ফেলে। দেশ স্বাধীনের পরে উদ্যোগ নেওয়া হয় সেখানে আরেকটি বটগাছ লাগানোর। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনকারী মার্কিন ডেমোক্র্যাট নেতা রবার্ট কেনেডি ঢাকা সফরে এলে তার হাত দিয়েই এই বটগাছটি রোপণ করা হয়। রাজনীতিক দিক থেকে এটি কোনো সাধারণ চারা রোপণ ছিল না। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই অধ্যাপক আকাশ দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।
১৯৭২ সালে এম এম আকাশ ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আসেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও তার রাজনৈতিক আদর্শের দলের কর্মী হিসেবে ‘ভিয়েতনাম দিবস’ কর্মসূচি পালন করতে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যখন তিনি আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (ইউসিস) সামনে পৌঁছান তখন মিছিলে গুলি বর্ষিত হয়। এই হামলায় তার একজন বন্ধু আহত ও আরেকজন বন্ধু নিহত হন।
অবশেষে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আগমন ঘটে। কিন্তু এখানেও আছে একটি মজার ঘটনা। তিনি চেয়েছিলেন দর্শন বিভাগে পড়তে কিন্তু তার রেজাল্ট দেখে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষকরা তাকে অর্থনীতি বিষয়টি নিতে রাজি করান। সে সময় অর্থনীতি বিষয় ছিল সবচেয়ে প্রার্থিত বিষয়গুলোর অন্যতম। শুধু মানবিক বিষয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, বরং বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিষয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়তে চাইতেন। মেধাবী এম এম আকাশ ছাত্রজীবনের পুরোটা সময় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও পড়াশোনায় তার প্রভাব পড়তে দেননি। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে।