বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সেই কাজ করুন যা আপনি ভালোবাসেন

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:২৩ এএম

অ্যাপল কম্পিউটার ও পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভ জবস ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে যে বক্তৃতা দেন তাতে নিজের জীবনের তিনটি ঘটনা উল্লেখ করেন। এই ঘটনাগুলোতে তিনি জোর দিয়েছেন পছন্দনীয় কাজটি করার। তরুণোদয়ের পাঠকদের জন্য বক্তৃতাটির বাংলা রূপ দিয়েছেন মোহাম্মদ মিহির আলী

ধন্যবাদ! পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আপনাদের সামনে উপস্থিত হতে পেরে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হইনি, এটাই আমার প্রথম কোনো সমাবর্তনে উপস্থিত হওয়া। আমি আপনাদের আমার জীবনের শুধু তিনটি গল্প বলতে চাই। এতটুকুই!

প্রথম গল্প

প্রথম গল্পটি হলো, বিচ্ছিন্ন বিন্দুগুলো কীভাবে পরস্পর যুক্ত হয়ে একটি সরলরেখা তৈরি করে সে সম্পর্কে। ছয় মাস পরেই আমি রিড কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু ছয় মাস পর থেকে ক্লাস করা বাদ দিই। কিন্তু নানাভাবে যুক্ত থাকি আরও আঠারো মাস। কিন্তু কেন আমি ক্লাস করা বাদ দিলাম? এ ঘটনার কারণটির সূচনা আমার জন্মেরও আগে।

আমার জৈবিক মা ছিলেন অবিবাহিত স্নাতক শিক্ষার্থী। তিনি তার সন্তানকে দত্তক দিতে মনস্থির করেন। তিনি দৃঢ়চিত্ত ছিলেন যে, তার সন্তানকে দত্তক গ্রহণকারীদের অবশ্যই স্নাতক হতে হবে। সেভাবেই সব ঠিক হলো। কিন্তু যখন আমি জন্মগ্রহণ করলাম তখন আমাকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক আইনজীবী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী জানালেন যে, তারা আসলে একটি মেয়েকে দত্তক নিতে চান। অপেক্ষমাণ লিস্টে যারা ছিলেন তারাই আমাকে দত্তক নেন। কিন্তু একটি অসুবিধা ছিল। তারা স্নাতক ছিলেন না। এটি যখন আমার জৈবিক মা জানলেন তখন তাদের দত্তক দিতে রাজি হলেন না। কিন্তু আমার দত্তক গ্রহণকারী মা-বাবা তাকে কথা দিলেন যে, আমাকে স্নাতক করতে তারা অবশ্যই কলেজে পাঠাবেন। এরপরেই আমার জৈবিক মা তাদের দত্তক দিতে রাজি হলেন।

১৭ বছর বয়সে আমি যে কলেজে গেলাম সেটি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ব্যয়বহুল ছিল। কিন্তু ছয় মাস পরে এর কোনো মূল্য খুঁজে পেলাম না। আমি জানতাম না যে, আমি কী হতে চাই আর এই কলেজের শিক্ষা কীভাবে আমাকে সাহায্য করবে। আর আমি এখানে ব্যয় করছি আমার পালক মা-বাবার কষ্টার্জিত অর্থ। সে কারণে আমি ক্লাস করা বাদ দিলাম। এখন পেছন ফিরে দেখলে আমি দেখতে পাই, সে সময় এই সিদ্ধান্ত নিতে আমি ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম কিন্তু এটা ছিল একটি ভালো সিদ্ধান্ত। যে বিষয়গুলো আমার ভালো লাগত না কিন্তু ক্লাস করতে বাধ্য হতাম সেগুলো আমি বাদ দিলাম আর সেই ক্লাসগুলো করা শুরু করলাম যেগুলো আমার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হতো।

গোটা ব্যাপারটাই যে রোমাঞ্চকর ছিল তা না। আমি ছাত্রাবাসে থাকতে পারতাম না। অন্য ছাত্রদের ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম। আমি ৫ সেন্টের জন্য কোকের ক্যান কুড়িয়ে জমা দিতাম। যা পেতাম তা দিয়ে খাবার কিনতাম। সপ্তাহের একদিন হরে কৃষ্ণ মন্দিরের একবেলার ভালো খাবারের জন্য সাত মাইল হাঁটতাম। এই জীবন আমার ভালোই লাগত। আমি আমার কৌতূহল আর কাণ্ডজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে চলতাম।

রিড কলেজে ছিল সে সময়ের সবচেয়ে ভালো ক্যালিগ্রাফি কোর্স। আমাকে যেহেতু সাধারণ ক্লাসগুলো করতে হতো না, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ক্যালিগ্রাফি কোর্স করব। এভাবেই আমি শিখলাম অসাধারণ টাইপোগ্রাফি কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে।

১০ বছর পরে যখন আমি ম্যাকিনটশ কম্পিউটার তৈরি করছিলাম তখন এই শিক্ষা আমার ভীষণ কাজে লাগল। আমি যদি এই কোর্সটি না করতাম তাহলে ম্যাক কম্পিউটারের এমন সুন্দর ফন্ট পাওয়া সম্ভব হতো না। যেহেতু উইনডোজ ম্যাককে নকল করেছে সে জন্য বলা যায়, আমি যদি ক্লাস করা বাদ না দিতাম আর ক্যালিগ্রাফি কোর্স না করতাম তাহলে কোনো ব্যক্তিগত কম্পিউটারেই এমন অসাধারণ টাইপোগ্রাফি থাকত না।

দ্বিতীয় গল্প

আমার দ্বিতীয় গল্পটি হলো ভালোবাসা ও হারানোর গল্প। ২০ বছর বয়সে আমি ও অজ আমার বাবা-মায়ের গ্যারাজে অ্যাপল শুরু করি। আর পরবর্তী ১০ বছরে এটি চার হাজার কর্মীর দুই বিলিয়ন মূলধনের একটি কোম্পানিতে পরিণত হয়। ৩০ পূর্ণ হওয়ার এক বছর আগেই আমাদের সবচেয়ে সুন্দর আবিষ্কার ম্যাকিনটশ বাজারজাত করি এবং ৩০ পূর্ণ হলে আমাকে অ্যাপল থেকে ছাঁটাই করা হয়। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার না, যে প্রতিষ্ঠানটি আপনি প্রতিষ্ঠিত করেছে সেটি থেকে আপনাকে কীভাবে ছাঁটাই করে? আসলে কোম্পানিটি যখন বড় হয়ে যায় তখন আমরা একজনকে নিয়োগ করি যিনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন বলে আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। প্রথম প্রথম সব ভালোই চলছিল। কিন্তু কোম্পানি বড় হতে শুরু করায় চিন্তাগত ব্যবধান বাড়তে থাকে এবং অন্য পরিচালকরা তার পক্ষ নেয়। পরবর্তী কয়েক মাস আমি ভেবেই পাইনি কী করব? আমাকে ছাঁটাই করা হলেও আমি যা করতাম তাকে ভালোবাসা কিন্তু বন্ধ হয়নি। পরে আমি ভেবে দেখলাম, ছাঁটাই হওয়াটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ঘটনা। এর ফলে আমি আবার নতুন করে শুরু করতে পেরেছিলাম। প্রথম নেক্সট বলে একটি কোম্পানি শুরু করি এবং পরে পিক্সার নামে আরেকটি। এই কাজের সুবাদেই আমি আমার জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছি যা আমার জীবনে এসেছে আশীর্বাদ হিসেবে।

তৃতীয় গল্প

এক বছর আগে, পরীক্ষা দ্বারা জানা গেল আমার ক্যানসার হয়েছে। ডাক্তার বললেন, প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে। সময় শেষ, এটি জানানোর এটি একটি ডাক্তারি কৌশল। আমি তখন চিন্তা করলাম, যে কাজগুলো পরবর্তী ১০ বছর ধরে করার কথা সেই কাজগুলো আমাকে তিন মাসে করে ফেলতে হবে? আমি যদি কয়েকদিনের মধ্যে মারাই যাই তাহলে কেন সেই কাজ করব যেগুলো আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না? সৌভাগ্যের বিষয় হলো, পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল আমার এমন একটি ক্যানসার হয়েছে যেটা সার্জারি করে অপসারণ করা সম্ভব। কিন্তু এটা থেকে এই শিক্ষা পেলাম যে, আমাদের সময় খুবই সংক্ষিপ্ত। নিজের কাছে অর্থবহ নয় তেমন কাজে ব্যস্ত থেকে নষ্ট করার মতো সময় আসলেই আমাদের নেই। তাই যে কাজ ভালোবাসেন সেই কাজই করুন। আমি নিজের জন্য যা চেয়েছি সেটি আপনাদের জন্যও চাই, ক্ষুধার্ত থাকুন, বোকা থাকুন।

(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত