কবি রফিক আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলা ভাষার অবিস্মরণীয় এই কবিকে কিন্তু বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিতই করেছিলেন বিভাগের শিক্ষকরা। তার বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণ ও বিভাগে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারা দুটোর পেছনেই রয়েছে কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা।
কবি যখন জন্মও নেননি, কেবল মাতৃগর্ভে সাত মাসের ভ্রুণ তখন তার বড় বোন অনাগত সহোদর বা সহোদরার নাম ঠিক করেন। তিনি আবদার করেন ছেলে হলে যেন তার নাম রাখা হয় ‘জীবন’ ও মেয়ে হলে ‘আর্জুমান্দ’। কবির এই বোনটি কলকাতার টোলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পড়তেন। মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল এই সন্তানটি যেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অনাগত সহোদর/সহোদরাকে তিনি দেখে যেতে পারেননি। কালাজ্বরে তার অকাল মৃত্যু ঘটে। কবির জন্মের পরে বিভিন্ন সময় এই ঘটনার কথা জানতে পারেন তার মায়ের জবানিতে। সেটা থেকেই তার মনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনা করার চিন্তা অঙ্কুরিত হয় এবং এটিকেই অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিষয়টি সহজ ছিল না। ঘটনা দুটি তিনি উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের স্মৃতিবিষয়ক নিবন্ধ ‘স্মৃতি সততই সুখের’ নিবন্ধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এখন যেমন অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হতো রফিক আজাদদের সময়ে তেমনটি ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমানে এইচএসসি) পরীক্ষার মার্কশিট বিভাগে জমা দিলে অফিস থেকে ইন্টারভিউয়ের একটি তারিখ দেওয়া হতো। নির্ধারিত দিনে শিক্ষকরা সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রার্থীকে বিভাগে ভর্তির অনুমতি দিতেন অথবা আবেদন খারিজ করে দিতেন। ইন্টারমিডিয়েটে বাংলায় রফিক আজাদের নম্বর তেমন ভালো না থাকায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, অনুমতি পাবেন কি না সে বিষয়ে। কলেজের বন্ধুরাসহ যারা সে সময়ে বিভিন্নভাবে পরিচিত হয়েছিলেন, তারা অবশ্য তাকে সাহস জোগাতে কসুর করছিলেন না। কিন্তু রফিক আজাদের দুশ্চিন্তা কমছিল না। নির্ধারিত দিনে মধুর ক্যান্টিনে তাই এক কাপ চা নিয়ে বসে ছিলেন গম্ভীর হয়ে। এ সময় সেখানে এলেন বুলবুল খান মাহবুব। তার কথায় কিছুটা আত্মবিশ্বাস পেলেন। তখন ডাক পড়ল, বাংলা বিভাগীয় প্রধানের অফিস থেকে। বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে ঢুকে দেখলেন, বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের দুই পাশে দুজন করে চার জন আছেন। শুরু হলো ইন্টারভিউ। প্রথম প্রশ্ন, বাড়ি কোথায়?
‘টাঙ্গাইল’।
বাড়ি টাঙ্গাইল শুনেই প্রশ্ন এলো, টাঙ্গাইল কীসের জন্য বিখ্যাত? চমচম, তাঁতের শাড়ি, গজারির বন, কুমুদিনী হাসপাতাল, পি সি সরকারের জন্মস্থান, মওলানা ভাসানীর কর্মস্থান, লোকসংগীত, টংক আন্দোলন ও প্রভৃতি বিষয়ে অবতারণা করেও খুব বেশি সন্তুষ্ট করতে পারলেন না প্রশ্নকারীকে। বাংলা বিষয় সম্পর্কে একটিও প্রশ্ন না করেই ওই শিক্ষক বোর্ডকে জানালেন, তার আর কোনো প্রশ্ন করার নেই। তখন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই বললেন, তোমার তো দেখছি ইংরেজিতে ভালো মার্কস আছে, বাংলায় ভেরি ‘পু-ও-র’, না বাবা, তুমি এক কাজ করো ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে যাও, আমি সাজ্জাদ হোসায়নকে বলে দিচ্ছি, তিনি যেন তোমাকে নিয়ে নেন; বাংলায় পড়ে তুমি কী করবে, খেতে-পরতে তো পারবে না, রেজাল্টও বাংলায় ভালো করবে বলে মনে হয় না, না খেয়ে মরবে, বুঝলে না খেয়ে মরবে’।
এমন সোজাসাপ্টা প্রত্যাখ্যানের কথা শুনে দুচোখে যেন অন্ধকার দেখলেন রফিক আজাদ। মরিয়া হয়ে বললেন, ‘স্যার, আগে থেকে খাওয়া-পরার চিন্তা করে আসিনি, এসেছিলাম মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা নেব, তা হলে তো স্যার আমাকে বাড়িতে গিয়ে চাষবাসে মনোযোগ দিতে হবে; তাছাড়া আমার বাবা-মাও আমাকে বাংলা ভাষাতেই পড়তে পাঠিয়েছিলেন, অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টের কথা তো তারা বলেননি; কেননা, তারা তাদের প্রথম সন্তানকে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে পড়িয়েছিলেন, সে বোনটি আমার অকালে ঝরে গেছে তাদের জীবন থেকে। এবার তাহলে বাবা-মাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে আমি অগত্যা কী পড়ব’।
মুনীর চৌধুরী এ আবেগঘন কথাগুলো শুনে বিভাগীয় প্রধানকে অনুরোধ করেন রফিক আজাদকে ভর্তি করে নিতে। উপস্থিত নীলিমা ইব্রাহিম ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীও সুপারিশ করেন। তাদের অনুরোধে রফিক আজাদ বাংলায় পড়ার অনুমতি পেলেন।
বাংলায় পড়ে রফিক আজাদকে অবশ্য না খেয়ে মরতে হয়নি। তিনি বাংলা একাডেমিতে সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছেন, সম্পাদনা করেছেন ‘উত্তরাধিকার’ ও ‘সাপ্তাহিক রোববার’, অধ্যাপনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। আর বাংলা সাহিত্যে তার অবদান তো চিরস্মরণীয় থাকবে যতদিন বাংলা সাহিত্য টিকে থাকবে ততদিন!