বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

এলজিইডির প্রকল্প

এক জেলাতেই ১৬০০ কোটি লোপাট!

  • প্রমাণ মিলেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তদন্তে
  • শ ম রেজাউল করিমসহ জড়িত আ. লীগের এমপি-মন্ত্রীরা
  • সংশ্লিষ্টতা মিলেছে ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর
  • হয়েছে বিভাগীয় মামলা, তথ্য পাঠানো হয়েছে দুদকে
  • ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্তের সুপারিশ
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৬ এএম

দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরে সরকারের ১৭টি প্রকল্প থেকে ১৬০০ কোটি টাকারও বেশি তছরুপের প্রমাণ পেয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে পিরোজপুরে বিগত ২০২০-২১ থেকে চারটি অর্থবছরে এই ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারের বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

এলজিইডির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারের ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল সোমবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা ও সাবেক মন্ত্রীর এই দুর্নীতিতে জড়িত থাকার তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পিরোজপুর-১ (নাজিরপুর, পিরোজপুর ও ইন্দুরকানী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলাম, নাজিরপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নূরে আলম শাহীন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
প্রতিবেদনে আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মে জড়িত ১১ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

তারা হলেন- আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, নির্বাহী প্রকৌশলী (পিআরএল ভোগরত), নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়, পিরোজপুর; আরিফুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়, পিরোজপুর; এ কে এম মোজাম্মেল হক খান, হিসাবরক্ষক, নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়, পিরোজপুর, এলজিইডি; মোহাম্মদ জাকির হোসেন মিয়া, সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী, নাজিরপুর উপজেলা; মো. বদরুল আলম, উপজেলা প্রকৌশলী, ভান্ডারিয়া উপজেলা; রিপন হালদার, সার্ভেয়ার, নেছারাবাদ উপজেলা, এলজিইডি; মোহাম্মদ আদনান আখতারুল আজম, প্রকল্প পরিচালক; সুশান্ত রঞ্জন রায় (পিআরএল ভোগরত), প্রকল্প পরিচালক; সৈয়দ আহম্মদ আলী (পিআরএল ভোগরত), প্রকল্প পরিচালক এবং কাজী মিজানুর রহমান (পিআরএল ভোগরত), প্রকল্প পরিচালক।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে গতকাল ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে পিরোজপুরে বিগত ২০২০-২১ থেকে চারটি অর্থবছরে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন এবং গৃহীত পদক্ষেপ-সংক্রান্ত’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

সেখানে জানানো হয়, তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৭টি প্রকল্পের ১ হাজার ৬৪৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তছরুপ করা হয়েছে। এই লুটপাটে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা। 

তিনি আরও বলেন, ১৬০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুর্নীতিতে সরকারের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

তা ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
 
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে জড়িত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্তসহ তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পিআরএল ভোগরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সব সরকারি পাওনা স্থগিত করা হয়েছে; তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুরোধ করা হয়েছে; অনিয়মের সঙ্গে জড়িত পিরোজপুর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে (সিএজি) অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের দুর্নীতি করতে সাহস না পান।’

জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারের (পিআরএল ভোগরত; সাবেক কর্মস্থল: পিরোজপুর) বিরুদ্ধে ঘুষবাণিজ্য, সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং মতামত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এদিকে, নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। সবপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। এখন হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে নানাভাবে মিথ্যাচার করছে। আমরা আশা করছি, ভারত আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আর হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, বিগত হাসিনা সরকারের আমলে তিনটি ভুয়া নির্বাচনের বিষয়ে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে এড়িয়ে গেছে। অথচ একটি ভবন ভাঙার বিষয়ে তারা বিবৃতি দিচ্ছে। এতে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এখানে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। তা ছাড়া শিগগিরই ঢাকা শহরের সব খেলার মাঠ দখলমুক্ত করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কাজ চলছে বলে জানান তিনি। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত