শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বিশ্বব্যবস্থার সংকট ও সম্ভাবনা

আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৪ পিএম

সভ্যতা অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অথচ বাস্তবতা একেবারেই আলাদা। বিশ্বের কিছু মানুষ বিলাসিতায় ডুবে আছে, আর কোটি কোটি মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। যুদ্ধ, অভিবাসন সংকট, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ দুঃসময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে পৃথিবী। ধনী দেশগুলোতে সম্পদের পাহাড় ক্রমে উঁচু হচ্ছে। আর অনাহারে ধুঁকছে হাজার হাজার শিশু, ভূমিহীন হচ্ছে লাখো শরণার্থী। বিশ্বায়নের সুফল যেখানে গোষ্ঠী শক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত, সেখানে বিপরীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর মানুষ নিরাপত্তাহীন। বিশ্বনেতারা বড় বড় সম্মেলন করে, বিবৃতি দেয়, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। পুঁজির নিয়ন্ত্রকরা চাইলে পৃথিবীর চেহারা বদলে যেতে পারত, কিন্তু তারা সেটা চায় না। যুদ্ধ ও সংকট তাদের হাতিয়ার, দুর্বল দেশগুলোর জনগণ কেবল তাদের স্বার্থরক্ষা করবে। এটাই কি সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ? নাকি পরিবর্তনের আশায় এখনো কিছু করা সম্ভব? ইতিহাস বলে, সংকটের মধ্যেই জন্ম নেয় বিপ্লব। মানুষ জেগে উঠলে, বিশ্ববিবেক যদি একত্রিত হয়, তবে হয়তো নতুন এক মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে। অন্যথায় সভ্যতার এই সংকট গভীর হবে, বৈষম্যের দেয়াল আরও উঁচু হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা বেঁচে থাকার লড়াই করছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার তথ্যমতে, পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত। শ্রমিকরা যাদের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে, তারাই তাদের যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে কৃপণতা দেখায়। প্রশ্ন হলো, এই বৈষম্যের সমাধান কোথায়? বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল গতিধারা এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ফলে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তন কি সত্যিই একটি নতুন ব্যবস্থা আনবে, নাকি আমরা পুরনো কাঠামোর ভিন্ন রূপ দেখব? বৈশি^ক শক্তির নতুন বিন্যাস দেখছি আমরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা আজ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো একক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করতে চাইছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে, ইউরোপ অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত এবং মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় নতুন জোট গঠিত হচ্ছে। 

বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা একটি সম্ভাব্য বিশ্বসংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এসব পরিস্থিতি বিশ্বকে নতুন সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। নতুন বিশ্বব্যবস্থা সম্ভব, তবে তা কোনো স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা নয়। এটি নির্ভর করবে বৈশি^ক শক্তির ভারসাম্য, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার ওপর। বর্তমান সংকট যদি সঠিকভাবে সামলানো না যায়, তবে আমরা পুরনোসমস্যার আধুনিক সংস্করণ নিয়েই এগিয়ে যাব। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো অভিবাসন ইস্যুতে দ্বৈত নীতি গ্রহণ করে চলেছে। যখন তাদের প্রয়োজন হয়, তখন তারা শরণার্থীদের স্বাগত জানায়; কিন্তু যখন অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ে বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপ তৈরি হয়, তখন কঠোর সীমান্ত নীতি গ্রহণ করে। এ যেন এক সূক্ষ্ম ক্ষমতার খেলা, যেখানে মানবিকতার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থই মুখ্য। উন্নত দেশগুলো প্রায়ই মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে তাদের কর্মকাণ্ড তার বিপরীত। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সংকট নিরসনে তারা বড় কোনো উদ্যোগ নেয় না, বরং অস্ত্র সরবরাহ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে উন্নত দেশগুলোর দিকে পাড়ি জমায়। অথচ এদের বড় অংশই সীমান্তে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর নীতি গ্রহণ করে সরকারগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চায়। জনমনে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা উসকে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটে। অথচ, এই অভিবাসীরাই অর্থনীতি, কৃষি, নির্মাণ ও প্রযুক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং অভিবাসন ইস্যুতে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের চেয়ে, বিশ্বনেতাদের উচিত যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মূল কারণ দূর করা। নতুবা, অভিবাসন সংকট কমবে না, বরং বৈশ্বিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। অভিবাসন নীতি কি মানবিক হবে, নাকি ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে থাকবে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

চীন বিশ্ব রাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু : বর্তমানে চীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু তার আঞ্চলিক সীমার মধ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তির দিক থেকেও আধিপত্য বিস্তার করছে। তাদের উন্নয়নশীল কৌশল, বাণিজ্যিক উদ্যোগ এবং আধুনিক সামরিক সক্ষমতা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে নতুন একটি শক্তির সমীকরণ তৈরি করেছে। চীনের অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী এক শক্তিশালী স্থান অধিকার করেছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) চীনের অর্থনীতির পরিমাণ বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে, যেখানে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI) বৈশ্বিক বাণিজ্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। চীন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বহু দেশে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করছে। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র এই নতুন অর্থনৈতিক শক্তি সম্বন্ধে চিন্তিত হচ্ছে, কারণ চীন অন্যান্য দেশের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরির মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে।

পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে চীনের উত্থান : চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির উন্নতি পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে চীন যে অবস্থান গ্রহণ করছে তা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞার পরেও চীন তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পথ এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। এভাবে চীন বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির একটি শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এবং তার অগ্রগতির ফলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক শক্তির তত্ত্ব ও সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে।

ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি : ভারত মহাসাগর আজকের বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভারত মহাসাগর শুধু বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্র নয়, বরং নিরাপত্তা ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারও ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)’ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিনিয়োগ করছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর এবং পাকিস্তানের গদর বন্দরে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভারতও ‘সাগর উদ্যোগ’ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ গ্রহণ করে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে এবং ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’-এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ অঞ্চলে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি করছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে, তেমনি নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে, চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিঘিœত করতে পারে। তাই, আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনার সন্ধান : বাংলাদেশ, একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে একদিকে যেমন ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখোমুখি, তেমনি অন্যদিকে সম্ভাবনার পথও খুঁজে পাচ্ছে। অভিবাসন সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে তার উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। প্রথমত, বাংলাদেশে অভিবাসন সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিদেশে অভিবাসন থেকে অর্জিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রতিনিয়ত এই রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং জাতীয় আয়ে শক্তি জোগাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশকে আরও বেশি দুর্বল করে তুলছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় ভূমি হারানোর সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবুও বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে কাজ করছে। বিশ্ব আজ দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও সংঘাত মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছে। সিরিয়া থেকে গাজার শিশু, আফ্রিকার শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রতিটি যুদ্ধ একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। কিন্তু বিশ্বনেতারা কি প্রকৃত অর্থেই এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন? বিশ্বনেতাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা ইতিহাসে কীভাবে স্মরণীয় হতে চান : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নাকি ক্ষমতার টিকিয়ে রাখার জন্য?

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত