শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ক্ষমা করতে ভালোবাসেন আল্লাহ

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম

ভুল করা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। মানুষ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ভুল করে। মহান আল্লাহ মানুষকে ভুল করার উপাদান-উপকরণ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। অস্বাভাবিক হলো, ভুলের ওপর অটল থাকা। অনুতপ্ত না হওয়া। অনুশোচনা না করা। মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। তিনি বান্দাদের জন্য তওবার দরজা সবসময় খোলা রেখেছেন। অসীম ক্ষমার দ্বারা তিনি বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। মহান আল্লাহ এতটাই দয়ালু যে, তিনি বান্দাদের গুনাহ মাফ করার জন্য অপেক্ষা করেন এবং অনুতপ্ত হলে তাদের ক্ষমা করে দেন।

মহান আল্লাহর অন্যতম গুণ ক্ষমাশীলতা। মহান আল্লাহ কোরআনে নিজেকে বারবার ‘গফুর’ তথা অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ‘তাওয়্যাব’ তথা তওবা কবুলকারী এবং ‘রহিম’ তথা পরম দয়ালু বলে পরিচয় দিয়েছেন। কোরআনে অসংখ্যবার এই বিষয়টি এসেছে, যেখানে মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি তার করুণা ও ক্ষমার কথা উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা ১৭৩) মহান আল্লাহ কোরআনের অন্যত্র বলেছেন, ‘আপনি বলুন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা জুমার ৫৩)

এই আয়াতে রয়েছে মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমার ঘোষণা, যা মানুষকে আশা দেয় যে, যত বড় গুনাহই করুক না কেন, আল্লাহর কাছে ফিরে গেলে তিনি ক্ষমা করবেন। পবিত্র কোরআনের অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ চান তোমাদের তওবা কবুল করতে।’ (সুরা নিসা ২৭) এখানে মহান আল্লাহর ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি চান তার বান্দারা তওবা করুক এবং এতে তিনি তাদের তওবা গ্রহণ করেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে মহান আল্লাহর ক্ষমাশীলতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বান্দাদের আল্লাহর রহমতের প্রতি আশাবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ তার বান্দার তওবায় তোমাদের ওই লোকের চেয়ে বেশি খুশি হন, যে লোক মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে ফেলে পরে তা ফিরে পেয়ে যেমন আনন্দিত হয়। (সহিহ মুসলিম) এই হাদিসে বোঝানো হয়েছে, মহান আল্লাহ বান্দার তওবায় এতটাই আনন্দিত হন যে, মরুভূমিতে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে থাকা একজন ব্যক্তি তার উট ফিরে পেলে যেমন খুশি হয়, তার চেয়েও বেশি খুশি হন আল্লাহ।

হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ ৯৯ জন হত্যাকারীর তওবা কবুল করেছিলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের আগের যুগের এক ব্যক্তি ৯৯ জনকে হত্যা করেছিল। পরে সে জানতে চাইল, পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম কে? তাকে একজন আলেমের সন্ধান দেওয়া হলো। সে ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে বলল, আমি ৯৯ জনকে হত্যা করেছি, আমার জন্য কি তওবার সুযোগ আছে? আলেম বলল, না। ফলে সে তাকেও হত্যা করল। এতে ১০০ পূর্ণ হলো। পরে এক আলেমের কাছে গিয়ে একই প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তওবার সুযোগ আছে। তুমি অমুক দেশে যাও। সেখানে কিছু লোক মহান আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন আছে। তুমিও তাদের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হও। নিজের ভূমিতে আর কখনো প্রত্যাবর্তন করো না। কেননা এ দেশটি ভয়ংকর খারাপ। তারপর সে চলতে লাগল। এমনকি যখন সে মাঝপথে পৌঁছে তখন তার মৃত্যু হয়ে গেল। তখন রহমতের ফেরেশতা ও আজাবের ফেরেশতার মধ্যে তার ব্যাপারে বাগবিতণ্ডা দেখা গেল, কে তার রুহ নিয়ে যাবে? রহমতের ফেরেশতারা বললেন, সে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তওবার উদ্দেশে এসেছে। আর আজাবের ফেরেশতারা বললেন, সে তো কখনো কোনো সৎ কাজ করেনি। এমতাবস্থায় মানুষের আকৃতিতে এক ফেরেশতা আসলেন। তারা তাকে নিজেদের মাঝে মধ্যস্থকারী বানালেন।

তিনি উভয় ফেরেশতাকে বললেন, তোমরা উভয় ভূখণ্ড পরিমাপ করো তথা মৃত ব্যক্তি এখন যেখানে আছে, সেখান থেকে তার তীর্থস্থান এবং তার মাতৃভূমির দূরত্ব পরিমাপ করো। এ দুটি ভূখণ্ডের মধ্যে যা নিকটবর্তী হবে, সেই অনুযায়ী তার ফয়সালা হবে। অর্থাৎ যদি মাতৃভূমির নিকটবর্তী হয় তাহলে আজাবের ফেরেশেতা নিয়ে যাবে। আর যদি তীর্থস্থানের নিকটবর্তী হয় তাহলে রহমতের ফেরেশতা নিয়ে যাবে। তারপর উভয়ে পরিমাপ করে দেখলেন যে, সে ওই ভূখণ্ডেরই বেশি নিকটবর্তী যেখানে পৌঁছার জন্য সংকল্প করেছিল। অতঃপর রহমতের ফেরেশতা তার রুহ নিয়ে যান। (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, একজন ব্যক্তি শতাধিক মানুষ হত্যা করেও যদি আন্তরিকভাবে তওবা করে, তাহলে মহান আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।

মহান আল্লাহ কেন ক্ষমা করেন? মানুষের দুর্বলতার কারণে ক্ষমা করেন। মহান আল্লাহ জানেন যে, মানুষ দুর্বল এবং ভুল করে। তাই তিনি বারবার ক্ষমা করার কথা বলেছেন। মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রচণ্ড ভালোবাসেন এবং চান তারা জান্নাতে প্রবেশ করুক। এ জন্য তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আমাদের করণীয় হলো, কখনো নিরাশ না হওয়া। পাপ যত বড়ই হোক, মহান আল্লাহর রহমত তার চেয়েও বড়। তাই আমরা কখনো নিরাশ হবো না। আমরা আন্তরিকভাবে তওবা করব এবং ভবিষ্যতে পাপ না করার দৃঢ়সংকল্প করব। নিয়মিত ইসতেগফার করব। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন ৭০ বার বা তারচেয়ে বেশি ইসতেগফার করতেন। আমাদেরও উচিত নিয়মিত ইসতেগফার করা। আমাদের ভালো কাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাপের পরিবর্তে নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হতে হবে, যাতে অন্তর পবিত্র হয়। মহান আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি চান না, কেউ গুনাহ করে ধ্বংস হোক, বরং সবাই তওবা করে সরল সঠিক পথে ফিরে আসুক। কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, মহান আল্লাহর রহমতের কোনো সীমা নেই। আমাদের উচিত, সবসময় তওবার পথে থাকা এবং তার ক্ষমার আশা করা।

লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত