এ কথা অনস্বীকার্য যে, এনবিআর ওরফে রাজস্ব বিভাগের যাবতীয় কাজই বিধিবিধান আইনকানুন প্রয়োগনির্ভর। প্রতি বছর অর্থ আইন আকারে এর কর্মপ্রক্রিয়া আইন পরিষদের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়ে থাকে। সংসদের অনুমোদন ছাড়া, শুল্ক কর আরোপের সুযোগ নেই। এনবিআরের কর্মতৎপরতা, কর্মকুশলতা এবং ন্যায়ানুগত্যতা সবই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি শাসিত। চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, আইনের প্রয়োগ তেমনি আইনের দৃষ্টিভঙ্গি ভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। আইনের ভাষা ও মেজাজ এবং প্রক্ষেপণ ও দর্শনের উদ্দেশ্য বিধেয়ে বিধৃত হয়ে থাকে। আইনপ্রণেতার মনোভাব, দূরদৃষ্টি, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, স্বভাব চরিত্র এবং আশা-প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে আইনের ভাষায়। যারা আইন তৈরি করেন তাদের সঙ্গে, যাদের জন্য আইনটি তৈরি করা হয়, অর্থাৎ যাদের ওপর এটির প্রয়োগ হবে তাদের মধ্যকার সম্পর্কেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। এখানে তৃতীয় আরেক শরিকের কথাও এসে যায়, যাদের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ হবে। তাদের কুষ্ঠিনামা বা বংশলতিকা, জাত্যাভিমান-অভিপ্রায়, তাদের সক্ষমতা-অক্ষমতার ব্যাপারটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য থেকে যায় আইনের প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতার ক্ষেত্রে। আইন পরিষদ যে আইন তৈরি করে তার প্রয়োগ হয়, যারা আইন তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে তাদের ওপর। আর এই আইন প্রয়োগের দায়িত্বও আইনপ্রণেতার নয়, নির্বাহী বিভাগের। এখন পরিবেশ পরিস্থিতি যদি এমন হয়, আইন শুধু অন্যের ওপর প্রয়োগের জন্য, প্রণেতা ও প্রয়োগকারীর ওপর বর্তায় না, তাহলে যাদের ওপর আইনের প্রয়োগ তারা হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও তারা যেন হয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীর। এই প্রতিপক্ষতার পরিবেশেই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায় নিবর্তনমূলক, প্রতিরোধাত্মক। এই প্রেক্ষাপটে আইন অমান্যের ও অগ্রাহ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর ও শুল্ক আইন জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক; শুল্ক আইনটির সূত্রপাত ব্রিটিশ আমলে হলেও এর ব্যাপক প্রয়োগ পাকিস্তান আমলে, দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণবাদী; মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এবং ২০১২ (২০১৯-এ নবরূপে প্রবর্তিত) মূলত পূর্বতন বিক্রয় করের উত্তরসূরি, এখনো নাবালক, সেবা শুশ্রুষা (সংস্কার) প্রত্যাশী; এবং এই তিন আইনই প্রয়োগিক দিক থেকে যথেষ্ট জটিল প্রতীয়মান হয়। অবশ্য এ কথা ঠিক, আয়কর আইন সব দেশেই কমবেশি জটিল, তবে দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগিক দিক দিয়ে দেশে দেশে এর পরিপালনযোগ্যতা যুক্তিগ্রাহ্য পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময়, কিংবা উৎপাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানান নামে নানান উপায়ে রাজস্ব বা টোল বা সেস আদায়ের প্রথা সেই আদি যুগ থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সাত সাগর তেরো নদীর পার থেকে আসা বিদেশি বেনিয়াদের দ্বারা। তৎকালীন সমাজে শিল্পবিপ্লবের পর পুঁজির প্রসার ঘটে এবং সেখানে সম্পদের ওপর, সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। যে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে তাতে বহির্বাণিজ্যে বাড়ে আমদানি-রপ্তানি। রাষ্ট্র ওই সব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আয়ের ওপর একটা হিস্যা দাবি করে বসে। যুক্তি এই, তুমি রাষ্ট্রের তৈরি অবকাঠামো ব্যবহার করে আয় উপার্জন করছ, রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা ভোগ করে লাভবান হচ্ছ সুতরাং এসব অবকাঠামো নির্মাণ, এসব সুযোগ-সুবিধার সমাহার বাবদ রাষ্ট্রের বিনিয়োগে তোমার অংশগ্রহণ চাই।
এ দেশে যারা আয়কর ও শুল্ক আইন আমদানি করেছিলেন, যে সময়ে এনেছিলেন, যাদের জন্য এনেছিলেন এবং যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিল এর প্রয়োগ-প্রবর্তনের ভার তাদের প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা-পর্যালোচনায় বিদ্যমান আইনের চরিত্র ও চারিত্র্য, এর শরীর ও শারীর শনাক্তকরণ সহজ হতে পারে। আমরা জানি, এদেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। রেজাখান সেতাব রায়দের মাধ্যমে রাজস্ব মাসোহারা প্রাপ্তির পর্ব পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই চালিয়েছিল শাসনকার্য। কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল এক্সপোর্ট বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে ইম্পোর্ট পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যার হাউজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভরসত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসাবাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি। এ প্রেক্ষাপটেই উৎপাদন, বিপণন, বাণিজ্যব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয় , প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ অবধি সীমিত অবয়বে আয়কর আদায়ের আয়োজন চলে। মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০ সালের পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে, স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারি করে কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব সার্কুলার ব্রিটিশ আইনের আদলে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত হলেও এ দেশীয় করদাতাদের প্রতি তাদের বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকিঝুঁকি দেওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই সার্কুলারের বাক প্রতিমায় প্রাধান্য পায়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর, প্রথমে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে Bangladesh (Collection of Taxes) Order, 1971(Acting President’s Order no. I of 1971) এবং পরে ১৯৭২ জানুয়ারি মাসে Bangladesh Taxes Law (Adaptation) Order , 1972 ( P.O 62 of 1972) জারির মাধ্যমে ১৯২২ সালের আয়কর আইন ও পাকিস্তান আমলে জারিকৃত অপরাপর কর আইনগুলো পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত করে প্রায় একই মেজাজে বলবৎ ও প্রযোজ্য করা হয়। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আয়কর অধ্যাদেশের স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে। লক্ষ্য করা যায় অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারাসমূহ তথা বিধানাবলি মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতাতেই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রণীত এবং এটি সে হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ এবং আয়কর আইন ২০২৩, ১৯৬৯ এবং ২০২৩ সালের শুল্ক আইন এবং ১৯৯১, ২০১২, ২০১৯ সালের মূল্য সংযোজন কর আইনের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বছর বছর অর্থ আইনে যেসব শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করেই মূলত ১৯২২ এবং পরবর্তীকালে জারি করা অন্যান্য মূল আইনের ভাব ভাষা দৃষ্টিভঙ্গি বলবৎ রয়েছে। প্রতি বছর শুল্ক ও কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, অবচয়, নিষ্কৃতি তথা ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ, অবচয়, নিষ্কৃৃতিও শুল্ক সুবিধা সংক্রান্ত মৌল দর্শন বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। যুগধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ সরলীকরণ তথা করদাতাবান্ধব ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়কীকরণের কাজ এগিয়েছে শম্বুকগতিতে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে কর আইন ও প্রয়োগ ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ সংবলিত সংশোধন সংযোজন বিয়োজন প্রয়াস যেন সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার মতো পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে।
দেশের কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনো যেন ঔপনিবেশিক আমলের পারস্পরিক অবিশ্বাস, সংশয় সন্দেহ, জটিলতার আবর্তে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে আসার পথ পরিক্রমায়। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিরুৎসাহিতবোধের কারণ হয়, আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সেই আইন ও বিধিবিধান প্রয়োগে অভ্যস্ত রাজস্ব বিভাগ এবং আইনের আওতায় করদাতাকে সহায়তাদানকারী ব্যবহারজীবীরাও তাদের মেধা ও বিজ্ঞ কৌশলেও সময়ের দাবির প্রেক্ষাপটে, আন্তরিক হয়েও সংস্কারে সফল অবস্থায় উত্তরণে গলদঘর্ম হন। বিভিন্ন পর্যায়ে বৈদেশিক সাহায্য-সহায়তায় নিয়োজিত বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান গোটা কর আইনসমূহকে পুনর্লিখিত করে যেসব খসড়া পেশ করা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে তার গ্রহণ ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে সংগত প্রশ্ন থেকে যায়। এ দেশের কর আইন হবে এ দেশেরই আবহমান অর্থনৈতিক সংস্কৃতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক। তাহলেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা।
লেখক: রাজস্ব নীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক