অল্প সময়ে অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় নিজেদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ব্যাপক হারে বাড়ছে গাজর চাষ। এবার চাহিদা ভালো থাকায় ভালো দামও পাচ্ছেন কৃষকরা। আবার গাজরের পাতা ও উচ্ছিষ্ট অংশ জোগান দিচ্ছে গরু-ছাগলের খাবারের। বর্তমানে দেশের গ-ি পেরিয়ে রপ্তানিও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এতে ভাগ্য খুলছে এ অঞ্চলের অনেক কৃষকের।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকায় গাজর চাষ শুরু হয়েছ প্রায় তিন যুগ আগে থেকে। প্রথম দিকে শুধু জয়মণ্টপ ইউনিয়নের দেউলী-দশানী ও ধল্লা ইউনিয়নের নয়াপাড়ায় স্বল্প পরিসরে এর চাষাবাদ শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় এখন উপজেলার দুর্গাপুর, চরদুর্গাপুর, ভাকুম, কিটিংচর, দেউলী, দশানী, নয়াপাড়া, মেদুলিয়া, গাজিন্দা, লক্ষ্মীপুর, নীলটেক, কানাইনগর, মোসলেমাবাদ, আজিমপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি কৃষক গাজর চাষের সঙ্গে জড়িত। গাজর চাষ অধ্যুষিত এ গ্রামগুলো এখন গাজর গ্রাম হিসেবে পরিচিতি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সিংগাইরে গাজর চাষ হয়েছে ৯৬০ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় ১০ হেক্টর বেশি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ হাজর ২০০ টন, যা বর্তমান বাজার মূল্য বিক্রি হবে অন্তত ৬৫ কোটি টাকার। তাদের দাবি, উপজেলায় উৎপাদিত গাজর দিয়ে দেশের চাহিদার ৪০ শতাংশই মেটানো যায়।
কথা হয় চরদুর্গাপুরের কৃষক রহিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি দুই যুগ ধরে গাজর চাষ করি। নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিও ভাড়ায় নিই। এ বছর আমি ১ একর ৮০০ শতাংশ জমিতে গাজর চাষ করছি । প্রতি বিঘায় (৩০ শতাংশ) খরচ হয়েছে নিজের জমিতে ৩০-৩৫ হাজার এবং ভাড়া জমিতে ৪০-৫০ হাজার টাকা। ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় গাজর মেলে ১২০-১৫০ মণের মতো। প্রতি বিঘা বিক্রি হয় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায়। এক সময় সংসারে অভাব থাকলেও গাজর চাষে এখন আমার দিন ঘুরেছে।’
নয়াডিঙ্গির কৃষক কাজী শাহাদাত হোসেন, চরদুর্গাপুরের জাহেদ আলী, চরআজিমপুরের সাইফুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিনসহ কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, গাজর চাষে সুবিধার পাশাপাশি বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বীজ বিপণনকারী সিন্ডিকেট। প্রতি বছর কোনো কারণ ছাড়াই এ সিন্ডিকেট বীজের দাম বাড়িয়ে দেয়। গত বছর কেজিপ্রতি বীজ কিনেছেন ১৫-১৬ হাজার টাকায়। এবার কিনতে হয়েছে ২৪-২৬ হাজার টাকায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে গাজর পরিপক্ব হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া এক মণ গাজর মাঠ থেকে বাজারজাত করতে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ হয় ১৪০ টাকা। হিমাগারে রাখলে ৮০ কেজি ওজনের এক বস্তা গাজরের জন্য গুনতে হয় এক হাজার টাকা। অন্যদিকে চীন থেকেও গাজর আমদানি করেন অনেকে। আমদানি বন্ধ হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হতেন।
ভাকুম এলাকার কৃষক জয়নাল হোসেন বলেন, ‘আগে গাজর নিজেরাই তুলে বিক্রি করতাম। এখন জমি থেকেই বিক্রি করে দিই। চলতি বছর সাত বিঘা জমিতে গাজর চাষ করছি। এতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো। গাজর পরিপক্ব হওয়ার আগেই ক্ষেত থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি।’
চরআজিমপুরের কৃষক বাবুল হোসেন জানান, চলতি বছর সাত বিঘা জমিতে গাজরের চাষ করেছেন তিনি। এতে তার খরচ হয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। বিক্রি করেছেন সাত লাখ টাকায়। বিঘাপ্রতি লাভ হয়েছে ৪০ হাজার টাকার মতো।
ভূমদক্ষিণ গ্রামের গাজর ব্যবসায়ী মো. আজমত আলী, আবেদ আলী ও মোহাম্মদ আলী জানান, তারা ১৫ বছর ধরে গাজরের ব্যবসা করে আসছেন। তারা চাষির জমি থেকে গাজর কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি বিক্রি করেন। এতদিন দাম ভালো থাকায় কিছু লাভ হয়েছে। এখন দাম একটু কমে যাওয়ায় মাঝেমধ্যে ক্ষতি হয়। কৃষকের জমি থেকে তাদের বেশ কিছু গাজর কেনা আছে। বৃষ্টিতে যদি ক্ষতি না করে তাহলে ব্যবসা ভালো হবে বলে আশা করছেন।
রাজশাহীর বাঘা থেকে আসা গাজর পরিষ্কার করা শ্রমিক সর্দার জাহাঙ্গীর বিশ্বাস বলেন, ‘আগে পা দিয়ে ঘষে গাজর পরিষ্কার করেছি। চলতি বছর মেশিন দিয়ে গাজর পরিষ্কার করছি। আগে পা দিয়ে ঘষে ৮০ কেজির ১২০ বস্তা গাজর পরিষ্কার করা যেত। একই পরিমাণ শ্রমিক মেশিনের সহায়তায় এখন ৮০ কেজির ৩০০-৪০০ বস্তা পরিষ্কার করা যায়। আমার দলে ১২ জন লোক আছে। ৮০ কেজির এক বস্তা গাজর পরিষ্কার করে বস্তাবন্দি করা পর্যন্ত আমাদের মজুরি বর্তমান ৯০-১০০ টাকা। দিনে গড়ে ১০০-১২০ বস্তা পরিষ্কার করা যায়। এতে প্রতিজনের ৮০০-১০০০ টাকা রোজ পড়ে। আয়-রোজগার বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এখন ভালো।’
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. হাবিবুল বাশার চৌধুরী বলেন, ‘সিংগাইরে গাজর চাষ উপযোগী পর্যাপ্ত জমি থাকায় এবং অল্প সময়ে অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় দিন দিন গাজরের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা চাষিদের গাজর চাষে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করার চেষ্টা করে আসছি। এ বছর সিংগাইরে ৯৬০ হেক্টর জমিতে গাজর চাষ হয়েছে। টাকার অঙ্কে প্রায় ৬৫ কোটি টাকার গাজর বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’
সাধারণত বেলে-দোআঁশ মাটিতে আশ্বিন-কার্তিক মাসে গাজরের বীজ বপন করতে হয়। ৯০ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে জমি থেকে তোলার উপযোগী হয়।