প্লট বরাদ্দে কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়েছে সরকার। এখন থেকে ক্ষতিগ্রস্তরা ছাড়া বাকিদের প্লট লটারিতে বরাদ্দ করা হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভূমি, প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ বিধিমালা ২০২৪ সংশোধন করে কোটা সংরক্ষণের নিয়ম বাতিল করেছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর সেকশন ১০২-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিধিমালার কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার ও তার দলের নেতাকর্মীদের নামে প্লট বরাদ্দের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করেছে। ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ভূমি, প্লট, স্পেস ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ) বিধিমালা-২০২৪’ সংশোধন করা হয়েছে। বিধিমালার ৭ নম্বর ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
নতুন বিধিমালার ৭ নম্বর ধারায় ‘ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থ সংরক্ষণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘এ বিধিমালার অন্য কোনো বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও মূল অধিবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আবাসিক প্লট সংরক্ষণ করা যাবে।’ আগের বিধিমালার ৭ নম্বর ধারায় ‘কোটা সংরক্ষণ’ শিরোনামে বলা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী, সরকারি কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণকারী (নিবাসী), সাংবাদিক, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বেসরকারি চাকরিজীবী ও শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, আইনজীবী, আইন ও আইনগত দলিলাদি নিরীক্ষার কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মচারী, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, চিকিৎসক, মূল অধিবাসী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আবাসিক প্লট সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছিল।
তাছাড়া রাজউকের যেকোনো প্রকল্পের আবাসিক প্লটে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের জন্য ২ শতাংশ, এ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর বা সংস্থাগুলোর কর্মচারীদের জন্য আরও ২ শতাংশ এবং রাজউকের কর্মচারীদের জন্য ২ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। নীতিমালা সংশোধনের ফলে প্লট বরাদ্দে সব ধরনের কোটা প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের সদস্য (ভূমি ও এস্টেট) ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইন করে প্লটের হরিলুট করা হয়েছে। ‘বিশেষ অবদানের’ কথা বলে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দারোয়ান, পিয়ন এবং ড্রাইভারও প্লট নিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করা হয়নি। এ দেশের জন্য তাদের কি কোনো অবদান নেই?’
তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার জন্য আন্দোলন করেছে তার মূলনীতির সঙ্গে প্লট সংরক্ষণের এ আইন সাংঘর্ষিক। সরকার প্লট বরাদ্দে কোটা প্রথা তুলে দিয়ে জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষা পূরণের কাজটি করতে চেয়েছে। এখন থেকে রাজউকের কোনো এলাকায় কোটায় কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই।’
ব্যক্তি পর্যায়ে সংরক্ষিত কোটায় সরকারি প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ অনুযায়ী এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইনটির ১৩/এ ধারা অনুযায়ী সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং যারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রেখেছেন, তাদের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার কথা। কিন্তু এ আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছামতো প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন বিগত সরকারের লোকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারি দলের অনুগত ছাড়া কেউ-ই এ কোটায় প্লট পায় না। বিগত সরকারের সময় এ ধারাটি ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ ধারায় পরিণত হয়েছিল। পিয়ন, ড্রাইভার, সচিব বা রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ-ই শেখ হাসিনার সুপারিশ ছাড়া প্লট পাননি।
তারা জানান, রাজউক প্লট বরাদ্দ দেয় সংস্থাটির অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলস ১৯৬৯ অনুসারে। এ বিধিমালায় রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়। বিধিমালাটি ১৯৮৬ সালে সংশোধন করে নতুন একটি উপবিধি (১৩এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এরশাদ সরকারের আমলে বিধিমালার এ ধারা অনুযায়ী প্লট বরাদ্দের কোটা প্রথার সূচনা করা হয়।
এ কোটার মাধ্যমে মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট ১৩এ ধারাটি আবার সংশোধন করে ১৩এ (১এ), (১বি) এবং (১সি) যুক্ত করে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাতে ১৩এ (১এ) উপধারায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের, ১৩এ (১বি) উপধারায় সংসদ সদস্যদের এবং ১৩এ (১সি) উপধারায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্লট বরাদ্দ করার বিধান রাখা হয়। এখন ২০০৯-এর বিধিমালা অনুসারে মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্লট দিয়েছে রাজউক।
এরপর বেশ কয়েকবার বিধিমালা সংশোধন করা হলেও কোটা পদ্ধতি বাতিল করার উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার। সবাই এ ধারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, কোটা প্রথার শুরুর দিকে ধানম-ি এলাকায় প্লট বরাদ্দ দিত সরকার। পরে পর্যায়ক্রমে গুলশান, বনানী-বারিধারা, মিরপুরের সরকারি আবাসন প্রকল্প থেকে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একাধিকবার সরকার গঠন করে সংরক্ষিত কোটায় প্লট ও বাড়ি বরাদ্দ অব্যাহত রাখে। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সচিব, কূটনীতিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা পেশাজীবীর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও এ সুবিধায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর নামে দুই প্লট থাকলে একটি বাতিল : সংশোধিত বিধিমালায় স্বামী-স্ত্রীর নামে প্লট বরাদ্দে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগের নীতিমালার ৪-এর উপ-বিধি (৯) সংশোধন করে বলা হয়েছে ‘কোনো ব্যক্তি নিজ নামে বা তার স্ত্রী অথবা স্বামীর নামে এ বিধিমালার অধীনে আগে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমি বা আবাসিক প্লট বরাদ্দ পেয়ে থাকলে তিনি উপ-বিধি (১)-এর অধীনে আবেদন করার অযোগ্য হবেন।’ তবে শর্ত থাকে যে, আবেদনকারী স্বামী বা স্ত্রী অথবা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত বা মূল অধিবাসী হিসেবে ভূমি বা আবাসিক প্লট বরাদ্দ পেয়ে থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
আগের বিধিমালার ৩-এর ৫-এর উপ-বিধিতে বলা হয়েছে, ‘ইতিপূর্বে যদি স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই পৃথকভাবে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমি বা আবাসিক প্লট বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে যেকোনো একটি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা হবে এবং অন্য প্লটটি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথভাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্লট বাতিল বা বরাদ্দ বহাল রাখার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।’
পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্য, মন্ত্রী, এমপি, আমলা থেকে শুরু করে নায়ক-নায়িকা, পিয়ন, দারোয়ান, ড্রাইভারের ‘বিশেষ অবদানে’ প্লট পাওয়া নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেয়ে দুটি কমিটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। কমিটিগুলো প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া ও আইনি বিষয়াদি যাচাই করছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত প্লট বাতিলের কাজ করছেন কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে ‘মুজিব’ সিনেমার অভিনেতা আরিফিন শুভকে সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দ দেওয়া প্লটটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া শেখ হাসিনার আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তত ১৫ জন গাড়িচালকসহ আমলা, সাবেক অনেক এমপি-মন্ত্রীদের প্লট রয়েছে বাতিলের তালিকায়।
রাজউকের একটি সূত্র বলছে, কোটায় বরাদ্দ দেওয়া আট শতাধিক প্লটে অনিয়ম পেয়েছে তারা। এ সংখ্যা বাড়তেও পারে। আরও যাচাই শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।