ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। এরপর পালিয়ে ভারতে যাওয়া হাসিনা এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। দেশ ছেড়ে পালানোর পর হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগে অনেক মামলা ও বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আদালত থেকে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও।
এমন অবস্থায় হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ। তবে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয়ে কোনো অবস্থান জানায়নি ভারত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যর্পণ এবং এর জটিল সমীকরণ নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সব প্রয়োজনীয় নথিপত্র ভারতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম নিশ্চিত করেছেন প্রয়োজন হলে নয়াদিল্লিকে একটি অনুস্মারক পাঠাতেও প্রস্তুত বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, প্রত্যর্পণের জটিল সমীকরণে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারত রাজি হবে কি না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের ওই দাবিটি গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে একটি নোট মৌখিক মাধ্যমে ভারতকে জানানো হয়েছিল। যদিও ভারত এখনো সেটির উত্তর দেয়নি। নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ইস্যুতে নীরব অবস্থান বজায় রেখেছে এবং বারবার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তিটি হয়েছিল ২০১৩ সালে। পরে ২০১৬ সালে চুক্তিটিতে সংশোধন করা হয় যাতে দুই দেশের মধ্যে পলাতক বন্দি ও আসামিদের বিনিময় আরও সহজ ও দ্রুত হয়। এই চুক্তিটি বেশ কিছু ভারতীয় পলাতক আসামি, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত আসামিদের বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা এবং (ভারতের) বাইরে কাজ করার প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল।
বন্দি বিনিময় এই চুক্তিটির কারণে ২০১৫ সালে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর শীর্ষনেতা অনুপ চেটিয়াকে সফলভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল নয়াদিল্লি। তারপর থেকে এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আরও একজন পলাতক আসামিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে।
বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, ভারতও এই চুক্তির মাধ্যমে অতীতে বাংলাদেশের পলাতক কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছিল।
চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশের এমন ব্যক্তিদের একে-অপরের কাছে প্রত্যর্পণ করার কথা যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, যদিও ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে হাসিনার প্রত্যাবর্তন চাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, তারপরও এই চুক্তিতে ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রভাবগুলো বেশ জটিলভাবেই রয়ে গেছে। ভারত যদি হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে রাজি হয়, তবে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির চিঠি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির বাস্তবতার সাপেক্ষে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে।
পাঞ্জাবের রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ল- এর সহকারী অধ্যাপক ড. সঙ্গীতা তাক বলেন, কৌশলগত বা পরিভাষাগত বিষয়গুলো মূলত প্রত্যর্পণ চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং মানবাধিকার বিবেচনা চুক্তিটিকে অবিশ্বাস্যভাবে জটিল এবং সংবেদনশীল ইস্যুতে পরিণত করবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছে হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের অনুরোধ জমা দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অনুরোধটিতে অবশ্যই হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশদ বিবরণ দিতে হবে এবং বিচারিক আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং অন্যান্য প্রমাণপত্রসহ সহায়ক অন্যসব নথি সংযুক্ত থাকতে হবে।
তাক জোর দিয়ে বলেন, প্রত্যর্পণের অনুরোধের মধ্যে অবশ্যই এই নিশ্চয়তাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে যে- বাংলাদেশে তার ন্যায্য বিচার হবে এবং সেই বিচার পক্ষপাতমূলক হবে না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, একবার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ দায়ের করা হলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-চুক্তির সকল বাধ্যবাধকতা পূরণ হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা শুরু করার কথা।
ড. সঙ্গীতা তাক বলছেন, যেহেতু ভারতের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে তাই ভারত সরকার সবকিছু পর্যালোচনা করবে এবং নিশ্চিত করবে যে, চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যর্পণের চুক্তিটি যথাযথভাবে এগোচ্ছে। আর এই পর্যালোচনা প্রক্রিয়াটি নির্ধারণ করবে- হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো উভয় দেশে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আইনত স্বীকৃত কি না।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষকেও পরীক্ষা করতে হবে, হাসিনার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ রাজনৈতিক, সামরিক বা ধর্মীয় অপরাধের জন্য ছাড়ের মধ্যে পড়ে কি না। আর এখান থেকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার ভিত্তি খুঁজে নিতে পারে ভারত— এমনটাই উল্লেখ করা হয় ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধে।
তবে প্রাথমিক প্রশাসনিক পর্যালোচনা অনুকূলে থাকলেও বিষয়টি সেখানেই শেষ হবে না। প্রত্যর্পণের অনুরোধ পরবর্তীতে ভারতে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সাপেক্ষে হবে। যেখানে বিশেষ প্রত্যর্পণ আদালত এর বৈধতা এবং যোগ্যতা যাচাই করবে।
তাক বলেন, ভারত প্রত্যর্পণের বিচারিক বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করবে। প্রত্যর্পণের জন্য নির্ধারিত ভারতের বিশেষ আদালত প্রত্যর্পণের অনুরোধের বৈধতা এবং যোগ্যতা পরীক্ষা করবে। আদালত যদি দেখে যে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কোনো হুমকি রয়েছে, তাহলে আদালত প্রত্যর্পণকে আটকে দিতে পারে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, রাজনৈতিক প্রতিশোধের লক্ষ্যে প্রত্যর্পণ আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্য এই বিচারিক সুরক্ষা অপরিহার্য। যাতে হাসিনাকে হস্তান্তরের যে কোনো সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে আইনের শাসনের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে।