বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

গাইবান্ধা পৌরসভা

৬% ঘুষ ছাড়া বিল হয় না

আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৫, ০৮:২৮ এএম

কাজের মান ও ব্যবহৃত সামগ্রীর মান নিয়ে প্রশ্ন না তুলে; কাজের কোনোরূপ তদারকি না করে তিনি যা চান তা হচ্ছে টাকা। টাকা অর্থাৎ ঘুষ দিলে তাকে দিয়ে সবই সম্ভব; চাহিদামতো ঘুষ পেলেই তিনি ঠাণ্ডা। প্রকল্পের কাজের বিল দিতে তার কোনো কার্পণ্য নেই। তবে ৬ পার্সেন্ট টাকা ছাড়া বিল পাস করেন না। কাজ ছাড়াই বিল-ভাউচার করে টাকা উত্তোলন এবং পৌরসভার যাবতীয় ভাউচারের কাজ করতে তার ঠিকাদার লাগে না, তিনি নিজেই তা করেন। এমন অভিযোগ উঠেছে গাইবান্ধা পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মোহাম্মদ শফিউল ইসলামের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কাছে ঘুষ-বাণিজ্যের একটি অডিওসহ অভিযোগ দিয়েছেন ফিরোজ কবির নামের এক ভুক্তভোগী। গত ১৫ জানুয়ারির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে তদন্ত করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন।

এক মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন এখনো দেওয়া হয়নি। অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন বলেন, ‘তদন্ত চলমান রয়েছে। প্রতিবেদন দাখিল করার আগে কিছু বলা যাবে না।’

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম চাকরিতে যোগ দেন। প্রায় ১৩ বছর ধরে গাইবান্ধা পৌরসভা কার্যালয়ে চাকরি করছেন তিনি। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চললেও ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ঘুষ-বাণিজ্য ছাড়াও দুর্ব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দ টাকার ৬% ঘুষ দিয়ে ছাড়াতে হয় ফাইল। পরিদর্শনে গেলে তার জন্য রাখতে হয় ঘুষের বিশেষ খাম।

যোগদানের পর তিনি পৌরসভার নকশা অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করতেন। ফলে এলাকায় কোনো বাসা-বাড়ি নির্মাণের নকশার অনুমোদনের জন্য তার কাছেই যেতে হতো। ওইসব নকশা অনুমোদনের জন্য তিনি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করতেন সেবাগ্রহীতাকে। পৌরসভায় সাত তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি না থাকলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নির্মিত হয়েছে সাত তলা ভবন। অবৈধ টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি, কিনেছেন জেলা শহরে জমিসহ বাড়ি। ঢাকা শহরেও তার ভবন রয়েছে।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পায় মেসার্স সুজন ফার্নিচার নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুসারে তারা কাজটি শেষ করে। কাজ চলমান অবস্থায় একাধিকবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দাবি করে ব্যর্থ হন তিনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শফিউল ইসলামের দপ্তরে বিল তুলতে গেলে ৬% ঘুষ দাবি করেন তিনি। ঘুষ ছাড়া বিল দেবেন না বলে জানিয়ে দেন। চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় ওই প্রকল্পের কাজের ফাইল হারিয়ে গেছে বলেন জানান তিনি। একপর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে প্রকৌশলী শফিউল ইসলামকে ঘুষ দেয়। এ টাকা তিনি নিজের কাছেই রাখেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এত কিছুর পরও আমরা কেউ মুখ খুলতে পারছি না। তদন্ত হলেই সব বেরিয়ে আসবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রকৌশলী শফিউল ইসলামের ঘুষ গ্রহণের একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের ওই অডিও ক্লিপে একটি প্রকল্পের কাজের টাকা (ঘুষ) চাইছেন তিনি। বরাদ্দ টাকার ৬ পার্সেন্ট দাবি করছেন তিনি।

ঘুষ কম দিতে চাইলে প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম বলেন, ‘একটি টাকাও কম দেওয়া যাবে না। টাকা কম দিলে বিল পাস করা যাবে না। একপর্যায়ে তিনি বলেন, এখানে আজরাইল আসলেও হবে না, ওই টাকাই দিতে হবে।’

শোনা গেছে, ঠিকাদার ওই সময় ৯০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছেন প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার বলেন, প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে এ পৌরসভায় আছেন। তিনি একটি ঘুষচক্র তৈরি করেছেন। তার কাছে সব ঠিকাদার জিম্মি।

তিনি দাবি করেন, ‘আমি নিজেও ওই প্রকৌশলীকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বিল তুলেছি।’ কেউ প্রতিবাদ করলে তার কাজে নানাভাবে হয়রানি করতেন। এমনকি এক সড়কের কাজে দুই থেকে তিনবার টেন্ডার নিতেন। সে উদাহরণ অন্য ঠিকাদারদের দিয়ে বলতেন, ‘আমার কথা মতো কাজ না করলে আপনাদের পরিণতিও ওদের মতো হবে।’

ঘুষ চাওয়ার অডিও বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। অভিযোগটি তদন্তাধীন।’  

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত