বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

আবার ‘ভাষাযুদ্ধ’ ভারতে

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৬:৫৫ এএম

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ভাষাযুদ্ধ’ কোনো নতুন ঘটনা নয়। ১৯৬১ সালে আসামের শিলচর, বরাক ভ্যালি বাংলা ভাষার দাবিতে উত্তাল হয়েছিল। সেদিন স্বাধীন ভারতে মাতৃভাষার জন্য ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন। প্রথম মহিলা ভাষাশহীদ ছিলেন কমলা ভট্টাচার্য। কিন্তু তাদের প্রাণদান ওপর ওপর কিছু সাফল্য পেলেও আজ, এই একুশ শতকেও আসামে বাংলাভাষী মানুষজন যথেষ্ট কোণঠাসা। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও বাংলার গুরুত্ব নেই। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে, বাংলায় কথা বলা লোকের সংখ্যা সব থেকে বেশি মুর্শিদাবাদ জেলায়। আর কম রাজধানী কলকাতায়। ফলে নতুন যে ভাষাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্তালিন ও তার দল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম, সংক্ষেপে ডিএমকে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই ভারতের দাক্ষিণাত্য, কখনো দিল্লি বা উত্তর ভারতের বশ্যতা মানেনি। বারবার তারা দিল্লির শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। নিজেদের পোশাক, ভাষা, সাহিত্যের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে দক্ষিণী বলয় সতত সক্রিয়।

পশ্চিমবঙ্গে, আমার ভাই বন্ধুদের অধিকাংশ মানতে চাইবেন তো নাই, গালাগালিই দেবেন, অন্তত মনে মনে। কিন্তু হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত সাধারণভাবে চিরকালই কর্তাভজা। তারা সবসময়ই শাসকদের পা লেহনে ব্যস্ত থেকেছেন। অখণ্ড বাংলায়ও মোগল বা ব্রিটিশ ভজনায় তাদের জুড়ি ছিল না। মাঝেমধ্যে বারো ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ ব্যতিক্রম। ব্রিটিশ ভারতে তো হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব পুরোপুরি ইংরেজের তল্পিবাহক হয়ে। কলকাতা শহরের যে কটি বনেদি, অভিজাত পরিবার, তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ব্রিটিশের খয়ের খাঁ হয়ে ভূসম্পত্তি করেছেন। লর্ড কর্নওয়ালিশ সাহেবের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে ছলে-বলে-কৌশলে জমি লুট করে জমিদারি পত্তন সম্ভব ছিল না ব্রিটিশদের গোলামি না করলে। ব্রিটিশ নব্য জমিদার গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ দমন করতে। পরবর্তী সময়ে যে স্বদেশি আন্দোলনকে বড় করে ইতিহাস দেখায়, তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। কিন্তু পাশাপাশি খোঁজ নিন। দেখবেন, স্বদেশিদের সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি ছিল খয়ের খাঁ-দের সংখ্যা। ব্রিটিশ চলে যেতেই বঙ্গসন্তানদের বড় অংশ নতুন কর্তা খুঁজে পেলেন দিল্লির গো বলয়ের শাসকদের মধ্যে। বাঙালি রাতারাতি যেভাবে হিন্দি, সংস্কৃতি ভাষা রপ্ত করে নিল তার ধারেকাছে অন্য কোনো রাজ্যবাসী পৌঁছতেই পারেনি। আর এখন তো দিন দিন পশ্চিমবঙ্গের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিন্দি কলচারাল হেজিমনির লেজুড় হয়ে শ্লাঘা অনুভব করছেন। বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে, গো বলয়ের সংস্কৃতির অনুসারী এখন বাঙালি।

সংগীত, গণেশ আরাধনা ইত্যাদি বহু কিছু। আমরা বড় তরল। যে পাত্রে রাখবেন, সেখানেই তার মতো হয়ে দিব্যি থেকে যাব। দক্ষিণ ভারত কোনোকালেই অত সুবোধ বালক নয় যে অন্যের সংস্কৃতি বিনাবাক্যে, যুক্তি ছাড়া মেনে নেবে। ফলে ভারতে নতুন যে ভাষাযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার নেতা মূলত তামিলনাড়ু হলেও, অন্যান্য দক্ষিণী রাজ্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সায় আছে। দক্ষিণী এই অস্মিতা প্রশংসাযোগ্য। এই ব্যতিক্রমী জাতীয়তাবাদী চেতনাই দক্ষিণ ভারতকে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তার রাজনৈতিক প্রতিনিধি বা বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, গায়ক অথবা সমাজের যে কোনো পেশার মানুষজন নির্দ্বিধায় পার্লামেন্ট থেকে পৃথিবীর কোনো বড় সভায় চলে যান নিজেদের পোশাকে। উত্তর ভারতের ঢক্কা নিনাদে দক্ষিণ চাপা পড়ে যায়। অথচ অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বত্রই দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর জয়জয়কার। সিনেমার তো কথাই নেই। জনপ্রিয় হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রের অধিকাংশ দক্ষিণী সিনেমার ডাবিং বা তার কপি পেস্ট।

ভারতের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, কোন কোনটি কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত, কোনটি রাজ্যের, কোনটি আবার কেন্দ্র-রাজ্য দুই তালিকাতেই আছে। যেমন বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত বিষয় পুরোপুরি কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত। আবার শিক্ষা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় তালিকায় রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, ভারত হচ্ছে ফেডারেল স্টেট। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেন্ট্রালাইজেশন অব পাওয়ার, অর্থাৎ দেশের যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে। নতুন শিক্ষানীতি সারা দেশে চাপিয়ে দেওয়ার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের কথাবার্তায়, তা সন্দেহজনক। এই শিক্ষানীতির বহুবিধ ধারা-উপধারার মধ্যে ত্রিভাষা সূত্র আসলেই হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল। আমাদের দেশে সাধারণভাবে প্রাথমিক স্কুলশিক্ষায় মাতৃভাষা ও আর একটি ভাষা ছিল আবশ্যিক, অপর কোনো ভাষা ঐচ্ছিক। স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকে দক্ষিণী ভাষাভাষী রাজ্যগুলো নিজেদের মাতৃভাষা, কন্নড়, তামিল, তেলুগু, মালয়ালামের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় পঠন-পাঠনের ওপর জোর দিয়ে এসেছে। তারা কখনোই হিন্দি ভাষাকে গ্রহণ করেনি। করতে চায়ওনি। আপনি তামিলনাড়ু বা কেরলে গেলে দেখবেন রাস্তাঘাটে সবজি বিক্রেতা থেকে সিএনজি চালক, বাস কন্ডাক্টর সবাই ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলবে কিন্তু হিন্দি জানলেও বলবে না। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সমস্ত সরকারি, বেসরকারি দপ্তর, রেলপথ, এক্সপ্রেসওয়ে সব জায়গায় সাইনবোর্ড থেকে ফরম ফিলাপ বা রেডিও, টিভিতে হিন্দি চর্চা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। কোনো কোনো সরকারি দপ্তরে তো হিন্দি না জানলে চাকরির উন্নতি অবধি আটকে দেওয়া হয়। হিন্দির ঢাক পেটানোর দৌলতে দেশে ও বিদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের ধারণা হয়ে গেছে হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা। আদপেই তা নয়। হিন্দি যোগাযোগের অন্যতম ভাষা মাত্র। স্বাধীনতার পর পরই লোকসভায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ভোটাভুটিতে হিন্দি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। হিন্দি মাত্র এক ভোট বেশি পেয়ে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাও সেই নীতি নির্ণায়ক মূল্যবান ভোটটি দিয়েছিলেন এক বাঙালি সংসদ সদস্য। তিনি হিন্দি ভাষার পক্ষে ভোট না দিলে হিন্দি আর পাঁচটি ভাষার মতোই রাজ্যের ভাষা হিসেবে থেকে যেত।

দক্ষিণ শুধু ভাষার প্রশ্নে নয়, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেও কাউবেল্টের হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান রাজনীতির ঘোর বিরোধী। সে বরাবরই আর্যাবর্তের মনুবাদী সংস্কৃতির বিপক্ষে- দ্রাবিড় কালচারের নেতা। ভারতের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সামাজিক ক্ষেত্রে আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ, দলিত দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক। বিজেপির মতো রেজিমেন্টেট দল, হাজার চেষ্টা করেও দক্ষিণ ভারতে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করতে যে ব্যর্থ হচ্ছে তার কারণ দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় স্বাভিমান। ভারতে আর্যদের প্রবেশ বারেবারে বিন্ধ্য পর্বতের দরজায় এসে থমকে গেছিল। স্বাধীনতার আগে থেকেই তামিলনাড়ুতে হিন্দি ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা চলেছে। তখন তামিলনাড়ু ছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। এলাকার শাসনক্ষমতা ছিল কংগ্রেসের হাতে। কংগ্রেসের নেতা চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। তিনি ছিলেন হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু তৎকালীন দ্রাবিড় জননায়ক পেরিয়ার ও আন্না দুরাইয়ের নেতৃত্বে গণআন্দোলন হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন।

দমন-পীড়ন চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেলেও তামিল জনগোষ্ঠী ছিল বিদ্রোহে অনড়। কয়েক হাজার আন্দোলনকারীকে জেলে বন্দি করা হয়। শহীদ হন পালামুত্তু ও নটরাজন। কিন্তু তামিল জনতাকে দাবিয়ে রাখা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ে। পেরিয়ার, আন্না দুরাই হয়ে পড়েন রূপকথার নায়ক। টানা কয়েক বছর ধরে চলার পর ১৯৪০ সালে আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিতে বাধ্য হন রাজাগোপালাচারী সরকার। কিন্তু তামিল জনমনে চারিয়ে গেল তামিল জাতীয়তাবাদ। তারপরে একাধিক সময়ে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ১৯৪০-এ। ফের ১৯৬৪-৬৫ সালে। ততদিনে দ্রাবিড় রাজনীতি বিপুল শক্তি সঞ্চার করে জাতীয় রাজনীতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। পেরিয়ার হয়ে উঠেছেন প্রবাদপ্রতিম জননেতা। আন্না দুরাই হয়েছেন তামিল রাজনীতির প্রাণ। জন্ম নিয়েছে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম, ডিএমকে। পরে ডিএমকে ভেঙে এডিএমকে হয়েছে। দু’দলের মধ্যে আকছাআকছি কম নয়। দুদলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে স্ট্রিট ফাইট তামিলনাড়ুর গ্রামেগঞ্জে প্রায় দিনের ঘটনা। কিন্তু তামিল ভাষার পক্ষে, হিন্দি আধিপত্যের বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধ।

এই ঐক্যবদ্ধ চেহারা বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব বাংলা দেখিয়েছিল ১৯৫২ সালে। ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা নতুন এক অধ্যায়ের পথে পা বাড়িয়েছিল। স্তালিনের নেতৃত্বে ভাষাযুদ্ধ কোন পথ নেবে তা এখনই বলা কঠিন। কিন্তু যে ঋজু মেরুদণ্ড স্তালিনের আছে তা সবার থাকে না এটা মেনে নিতেই হবে। বাংলাদেশ প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের অনেক বক্তব্য। অনেক ঘৃণা। অনেক কটূক্তি। একুশ এই বঙ্গ হঠাৎই একদিনের জন্য ভাষাপ্রেমিক সাজেন। কিন্তু কজন বাংলা ভাষা ভালোবাসেন সন্দেহ আছে। ভালোবাসলে তারা রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারদের মতো সাহস করে রাস্তায় না নামতে পারুন, হিন্দি আধিপত্যের কাছে নিজেদের মায়ের ভাষাকে বেচে অন্তত দিতে পারতেন না। তামিলনাড়ুর লড়াইকে আসুন কুর্নিশ করি।  তামিলনাড়ুর ভাষা সংগ্রাম জন্ম নিয়েছিল ১৯৩৭ সালে। ভুলে গেলে চলবে না, ওই একই সালে আসামের বিধানসভায় এক তরুণ সদস্য দাবি তুললেন, তাকে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তব্য রাখতে দিতে হবে। হাজারো টালবাহানার পরে স্পিকার মেনে নিতে বাধ্য হলেন, মাননীয় জনপ্রতিনিধিকে বাংলায় বলতে দিতে। সেদিন ইতিহাস সৃষ্টি হলো। তখন কেই-বা ভেবেছিলেন যে, এই তরুণ পূর্ব বাংলার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকবেন। সেই তরুণ আজীবন ছিলেন গরিবের পক্ষে। তিনি আর কেউ নন, মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৩৭ সাল তাই ভাষাসংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, স্মরণীয় বছর।

লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত