মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সিরিয়ায় হত্যার বিভীষিকা

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৭:০৩ এএম

দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান হলেও নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত অঞ্চলগুলোয় সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতা ও প্রতিশোধমূলক হত্যা অব্যাহত আছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আসাদপন্থিদের সংঘর্ষে ইতিমধ্যে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। সিরিয়ার উপকূলীয় প্রদেশ লাতাকিয়া ও তারতুসে শত শত মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ দুই প্রদেশ আসাদ সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হায়াত তাহরির আল শাম যোদ্ধারা সেখানে ব্যাপক মাত্রায় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি গণহারে লুটপাট চালাচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরা।

গত বৃহস্পতিবার থেকে এই সংঘাতের সূত্রপাত। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক আসাদের অনুগত ব্যক্তিরা, যারা অস্ত্র জমা দিতে রাজি হননি, তারা লাতাকিয়া ও জাবলেহ শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা হামলা চালায়। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হয়। এ হামলার পেছনে আসাদ বাহিনীর এক সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গিয়াথ ডাল্লাহ কলকাঠি নেড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সিরিয়ার নতুন সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর এসব হামলার পর মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায় নিরাপত্তা বাহিনী লাতাকিয়া এবং তারতুসে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং সাক্ষ্য অনুসারে, প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের কারণে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাতাকিয়ার দাতুর এলাকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সশস্ত্র লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালিয়েছে। মিডল ইস্ট আইকে ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বানিয়াস এলাকায় আমার বন্ধুর বাগদত্তা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কেউ তাকে সাহায্য করতে পারেনি। সে রক্তক্ষরণে মারা গেছে। তারা এখনো তাকে কবর দিতে পারেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় বুস্তান আল-বাশা গ্রামে থাকেন। সেখানে তার সব প্রতিবেশীকে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের সিরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধা দাবি করা এসব সশস্ত্র লোকজন ওই প্রত্যক্ষদর্শীর বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছেন বলে জানা গেছে। সেখান থেকে প্রায় ২০টি গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘অস্ত্রধারীরা নিজেদের এইচটিএসের যোদ্ধা দাবি করলেও তা সত্যি নয়। তারা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য বলে তার মনে হয়েছে।’ তিনি বলেন, যে ব্যক্তিই পালাতে চেষ্টা করছেন বা যাকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে, তাকেই হত্যা করা হচ্ছে। কিছু সাধারণ নাগরিক লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়া পরিচালিত হোমেইমিম বিমানঘাঁটিতে পালিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। সিরিয়ার উপকূলীয় নগরী বানিয়াসের পাশের শহরতলি হাই আল-কুসুর আলাউইতদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানকার বাসিন্দারা বলেছেন, সেখানে সড়কে মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে আছে, স্তূপ হয়ে আছে এবং সড়ক রক্তে ভেসে গেছে।

এসওএইচআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাতাকিয়া ও তারতুসে আলাউইত সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ৭৪৫ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে বাশারপন্থি ১৪৮ যোদ্ধাকেও হত্যা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি জানিয়েছে, সিরিয়ার নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১২৫ সদস্যও নিহত হয়েছেন। শিয়াপন্থি আলাউইতরা সিরিয়ার একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ আলাউইত। সাবেক স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পরিবারও এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশের সঙ্গে বাশার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার সরকারের পতনের পর থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষকে হামলার লক্ষ্য বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে, সিরিয়ায় নতুন সংঘাত ও রক্তপাতের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করার অঙ্গীকার করেছেন দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, কয়েক দিন ধরে চলা সংঘর্ষের পর বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি করার সঙ্গে জড়িত যে কাউকে জবাবদিহি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আল-শারা। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানার পোস্ট করা ভিডিও ভাষণে শারা আরও বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে এবং প্রশ্রয় ছাড়াই সেই অপরাধীদের জবাবদিহি করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোকে লঙ্ঘন করেছে বা নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্র্তৃত্বের অপব্যবহার করেছে।’ তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না এবং যাদের হাত সিরিয়ার নাগরিকদের রক্তে রঞ্জিত, তারা শিগগিরই বিচারের মুখোমুখি হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত