সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

আর্জেন্টিনায় অভিবাসীদের রমজান

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৫, ০৭:১০ এএম

আর্জেন্টিনায় ১০ লাখ মুসলমান বসবাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ ভাগ। দেশটির মুসলমানরা রমজান মাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করেন। তবে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আগত অভিবাসীরা নিজ দেশের রমজান সংস্কৃতির অভাব অনুভব করেন। আর্জেন্টিনায় শীতকালে দিন খুব ছোট হয়। এ সময় রমজানের রোজা রাখতে হয় মাত্র ৯ ঘণ্টা। অন্য ঋতুতে রমজানের আগমন ঘটলে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টার মতো রোজা রাখতে হয়। রমজানে মসজিদগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার আয়োজন করা হয়। আর্জেন্টিনার মুসলমানরা রমজানকে আধ্যাত্মিক উন্নতির মাস হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিজেদের ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত রাখতে একত্রে চেষ্টা চালিয়ে যান।

সম্প্রতি মরক্কোর সংবাদ সংস্থা মাগরেব আরব প্রেস আর্জেন্টিনায় বসবাসরত তিন মরক্কোর অধিবাসীর সাক্ষাৎকার নেয়। সাক্ষাৎকারে উঠে আসে আর্জেন্টিনায় তাদের রমজান পালনের অভিজ্ঞতা। নিজ দেশে রমজান পালনের নস্টালজিক অনুভূতিও জানান তারা। তাদের একজন মুহাম্মদ মুরাদি। তিনি ছয় বছর আগে আর্জেন্টিনায় আসেন। বসবাস শুরু করেন রাজধানী বুয়েনস আইরেসে। প্রতি বছর রমজান এলেই তিনি মরক্কোর স্মৃতিতে হারিয়ে যান। তার কাছে এই পবিত্র মাসের স্বাদ আলাদা, যা তাকে আর্জেন্টাইন পরিবেশে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ করে তোলে। যদিও তিনি দেশটিতে বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে মিলেমিশে রমজানের অনুরূপ পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘রমজান এলেই অনেকে রোজার সময় গুনতে শুরু করেন এবং মনে করেন যে আবহাওয়ার দিক থেকে আর্জেন্টিনা রোজার জন্য সবচেয়ে উপযোগী দেশগুলোর মধ্যে একটি। তারা মনে করেন, আর্জেন্টিনায় মুসলমানরা রোজার সময় ক্ষুধা বা তৃষ্ণা অনুভব করেন না। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, এই দেশে আমরা আমাদের সেই রমজানের পরিবেশ থেকে বঞ্চিত, যা আমরা মরক্কোতে পেতাম। যেখানে পরিবারের উষ্ণতা অনুভব করা যেত, ইফতারের সময় সবাই একসঙ্গে বসত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান কানে বাজত এবং নামাজের সময় মসজিদগুলো মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত।’

মুহাম্মদ মুরাদি জানান, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস, মেনডোজা, টুকুমানসহ বিভিন্ন শহরের স্কুল ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম সম্প্রদায়কে আরও ঘনিষ্ঠ করতে ভূমিকা রাখছে এবং রমজান মাস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করছে। তবে এই সবকিছু মুরাদির জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘যত কার্যক্রমই হোক না কেন, এটি কখনোই মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী ইফতারের পরিবেশের অভাব পূরণ করতে পারবে না।’

মুরাদি বর্তমানে বুয়েনস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন এবং পাশাপাশি আর্জেন্টিনার রাজধানীতে কিং ফাহদ ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে দোভাষী ও অনুবাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি মরক্কোর জায়ো শহরের হাসান ইবনে সাবিত উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু পরে তিনি তার আর্জেন্টাইন স্ত্রী নাইমার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং আর্জেন্টিনায় চলে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি রমজানকে মরক্কোর মতো করে কাটানোর চেষ্টা করি। মরক্কোর কারিদের কোরআন তেলাওয়াত অনলাইনে শুনি এবং মরক্কোর রেডিও স্টেশনগুলোর রমজান সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত অনুসরণ করি। এটি আমার জন্য একটি বার্ষিক অভ্যাস হয়ে গেছে।’

মুহাম্মদ মুরাদি মনে করেন, ভিন দেশে বিয়ের কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে, যা বিশেষ করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন বিদেশি জীবনসঙ্গী রমজানের শুভেচ্ছা জানাতে পারে এবং ইফতার প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতি ও পরিবেশের পার্থক্যের কারণে কিছু আবেগঘন দিক শেয়ার করা তার জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। মুরাদি আরও জানান, তিনি তার দেড় বছর বয়সী মেয়ে সুকাইনাকে ইসলামি শিক্ষায় বড় করতে চান এবং তার আগামী মরক্কো সফরে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, যাতে সে তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।

খাইরা মুহিউদ্দিন পেশায় একজন রন্ধনশিল্পী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বুয়েনস আইরেসে বসবাস করছেন, তিনি বলেন, ‘আর্জেন্টিনায় রমজানের পরিবেশ মুসলিম দেশগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে কাজের সময়সূচি পরিবর্তন হয় না। এমনও হয় যে, কেউ কেউ তার কর্মস্থলে বসেই ইফতার করতে বাধ্য হন। আমি যখন বাসায় ফিরি, তখন পরিবারের সঙ্গে সংযোগ থাকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি এবং তাদের সঙ্গে মরক্কোর রমজানের পরিবেশের স্মৃতিচারণ করি।’

মুহাম্মদ বেননিস ১৮ বছর ধরে আর্জেন্টিনায় কূটনৈতিক মিশনে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘রমজান আমার জন্য স্বদেশিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ বয়ে আনে। এ সময় আমি অন্য মরক্কোর নাগরিকদের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইফতার করি। আমার স্ত্রী ঐতিহ্যবাহী মরক্কোর খাবার রান্না করেন, যা আমাদের দারুণভাবে বিস্মিত করে। আমরা স্মৃতিকাতর হয়ে যাই এবং নস্টালজিয়ায় ভুগি। আমি যত বছরই আর্জেন্টিনায় থাকি না কেন, আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রমজান ছিল ২০১০ সালে, যখন আমি আমার জন্মস্থান ফেজ শহরে গিয়েছিলাম। আমি এখনো সেই স্মৃতিগুলো হৃদয়ে লালন করি এবং এখানে থাকার পরও সেগুলো পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করি।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত