সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাত শেষে গত বছর ডিসেম্বরে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিদ্রোহী দলগুলোর নেতৃত্ব দেওয়া হায়াত তাহরির আল-শামের যোদ্ধারা। যার মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের অবসান হয় দেশটিতে। তবে তিন মাসের ব্যবধানে আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে আরব দেশটি। বাশারের আলাউইত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বর্তমান শাসকদের অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান নতুন করে অশান্তির আগুন উসকে দিয়েছে। আলাউইত অধ্যুষিত অঞ্চলে অভিযানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেশটির ভবিষ্যৎ সংস্কার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আল-শারার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে, মতবিরোধ থাকলেও নতুন সিরিয়ার বিনির্মাণে সিরিয়ার কুর্দি নেতৃত্বাধীন এসডিএফের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই চুক্তি এমন একসময়ে স্বাক্ষরিত হলো, যখন বেসামরিকদের হত্যার ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে।
বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বৃহস্পতিবার সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া ও তারতুসে ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদের অনুগত যোদ্ধারা সমন্বিতভাবে হামলা শুরু করেন। লাতাকিয়া ও তারতুস বাসার সরকারের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, কয়েক দিনের গণহত্যায় অন্তত ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন। অন্যদিকে দুপক্ষের সংঘাতে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৩১ জন আর আসাদ সমর্থক ২৫০ জন মারা গেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৩১১ জন। বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটিতে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা এটি। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট শারার কার্যালয় জানিয়েছে, সংঘাত ও উভয় পক্ষের হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে দেখার জন্য একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
অনেকে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তকে। তিনি কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সিরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সব বাহিনী ভেঙে দিয়েছেন। এর ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন ও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তাকেও চাকরিচ্যুত করেছে নতুন প্রশাসন। সিরিয়ার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং তাদের একটা বড় অংশের চাকরি নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, সিরিয়ার নতুন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় যোগ দেওয়ার জন্য দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে কুর্দি নেতৃত্বাধীন ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের দপ্তর জানিয়েছে, গত সোমবার রাজধানী দামেস্কে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ও এসডিএফ কমান্ডার মজলুম আবদি করমর্দন করছেন। সিরিয়ার তেলসমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা এসডিএফের নিয়ন্ত্রণে আছে। চুক্তিতে হওয়া সমঝোতা অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের এসডিএফ-নিয়ন্ত্রিত বেসামরিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হবে।
চুক্তিটিতে জানানো হয়েছে, এসডিএফের নিয়ন্ত্রণে থাকা সীমান্ত ক্রসিং, একটি বিমানবন্দর এবং সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলো দামেস্ক প্রশাসনের অংশ হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক মন্তব্যে কুর্দি নেতা আবদি বলেন, চুক্তিটি একটি নতুন সিরিয়া গড়ে তোলার সত্যিকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তিনি জানান, এসডিএফ খুব সংকটজনক একসময়ে ক্রান্তিকালীন পর্যায় নিশ্চিত করার জন্য সিরীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছে, যা ন্যায় ও স্থিতিশীলতার জন্য সিরিয়ার জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। চলতি বছরের মধ্যে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এসডিএফের সামরিক অভিযানগুলো কীভাবে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে, চুক্তিতে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। আলোচনায় এ বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো সমঝোতা হয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
তবে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলেও, তাদের নীতিগত ফারাক রয়েছে। উভয় পক্ষই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় ভঙ্গুর সিরিয়ার পুনর্নির্মাণে তাদের ঐকমত্যের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই বন্ধন কতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়েও অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।