রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। এটি এ মাসের বিশেষ আমল। রোজার সব আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। রমজান মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্তর পরিশুদ্ধি, আত্মসংযম ও তাকওয়া অর্জনের এক অনন্য মাস। এটি শুধুমাত্র উপবাসের মাধ্যমে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা অনুভব করার নাম নয়, বরং এটি এমন একটি ইবাদাত, যা মানুষকে নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে শেখায় এবং আল্লাহভীরু হওয়ার পথে পরিচালিত করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক সময় আমরা মুল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ইসলামের বিধানগত বিষয়ে মতপার্থক্য নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে যাই। যেমন তারাবি ৮ রাকাত না ২০ রাকাত হওয়া উচিত, তারাবির চার রাকাত পর পর মোনাজাত করা যাবে কি না? মোনাজাতে হাত তোলা উচিত কি না? এসব নিয়ে মতভেদ চলতে থাকে।
এসব বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে মূল ইবাদত থেকে মনোযোগ সরে যায়। অথচ হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বিতর্ক নয়, ঐক্যের শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো আত্মশুদ্ধি, অন্যের প্রতি সদয় হওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। বিতর্কের মাধ্যমে যদি নিজেদের অন্তরকে কলুষিত করি, তাহলে আমাদের রোজা ও ইবাদত কোনো কাজে আসবে না।
ইসলামের শিক্ষা হলো অন্তরের পরিশুদ্ধি, ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আত্মার উন্নতি এবং কোরআনে কারিমের শিক্ষাকে জীবনের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়ন। রোজার প্রকৃত লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) হতে পার।’ (সুরা বাকারা ১৮৩)
বর্ণিত আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। এটি কেবলমাত্র উপবাস থাকার অনুশীলন নয়, বরং এটি মানুষকে আত্মসংযম শেখায়, লোভ ও পাপাচার থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ প্রশস্ত করে। ইবাদাত শুধুমাত্র বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধি। আমাদের নামাজ, রোজা, দান-সদকা, তারাবি ইত্যাদি ইবাদত যদি আমাদের চরিত্রের উন্নতি না ঘটায়, তাহলে এসব ইবাদতের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার আছে, যাদের উপবাসের দ্বারা কিছুই লাভ হয় না, শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছাড়া।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৬৯০)
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধুমাত্র উপবাস থাকা যথেষ্ট নয়, বরং মনের শুদ্ধতা, অন্যের প্রতি সদয় হওয়া এবং আমাদের কথাবার্তা ও আচরণে সংযম থাকা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, রমজান শুধু উপবাসের মাস নয়, বরং এটি কোরআন মাজিদ অবতীর্ণ হওয়ার মাস। কিন্তু আমরা কি কোরআনে কারিমের অর্থ বোঝার চেষ্টা করি? শুধু তেলাওয়াত করলেই কি আমরা সঠিকভাবে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারব?
কোরআন এমন একটি গ্রন্থ যা আমাদের জন্য পথনির্দেশিকা। এটি শুধুমাত্র তেলাওয়াতের জন্য নয়, বরং বোঝার ও অনুসরণের জন্য এসেছে। তাই রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল করতে হলে আমাদের উচিত কোরআনের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করা এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা।
এক কথায়, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, অন্তরের পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জন। এটি আমাদের চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ দেয়, কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ করে দেয় এবং সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর পথ দেখায়। তাই আমাদের উচিত, বাহ্যিক বিতর্ক ও মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মশুদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করা, কোরআন মাজিদ বোঝা এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করা।
লেখক : প্রিন্সিপাল, পদুয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা, ফেনী