২০০২ সালের ২ জানুয়ারি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ট্যানারি পুকুরপাড় এলাকায় একটি বাসায় ধর্ষণের শিকার হন ২২ বছর বয়সী এক তরুণী। মামলার পর তদন্ত শেষে আদালতে দাখিল করা হয় অভিযোগপত্র। এরপর বিচার শুরু হলেও মামলার ২৩ বছর এবং অভিযোগপত্র দাখিলের ২২ বছরেও মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মীরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, এই একটি মামলাই ধর্ষণ মামলায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অসংখ্য নেতিবাচক দৃষ্টান্তের একটি।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এ বিচারাধীন এ মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, জীবিকার তাগিদে ওই তরুণী স্থানীয় এলাকায় রংমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন। সেখানে পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে ঘটনার দিন তোতা মিয়া, লিটন, জামাল, বারেক ও শহীদুল ইসলাম তার গলায় চাকু ধরে শহীদুলের বাসায় নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে তরুণীর চিৎকারে লোকজন জড়ো হলে আসামিরা পালিয়ে যায়। তদন্ত শেষে একই বছরের ৩০ মে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তোতা, লিটন, জামাল, বারেক ও শহীদুলের বিরুদ্ধে নারী এবং শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭/৯ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়। সাক্ষী করা হয় বাদী, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৫ জনকে। ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালত-১ অভিযোগ গঠন করে বিচার (সাক্ষ্যগ্রহণ) শুরুর আদেশ দেয়।
২০১৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বরের পর ৯ বছর সাক্ষ্যের জন্য তারিখের পর তারিখ পড়লেও কোনো সাক্ষী না আসায় কার্যত বিচার কার্যক্রম থমকে যায়। সমন জারির পর গত বছরের ২১ মে একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়ে যান। এরপর আর কোনো সাক্ষী আদালতে আসেননি। আদালতসংশ্লিষ্টরা জানান, আসামি তোতা ও জামাল মামলার শুরু থেকে পলাতক। শহীদুল জামিনে গিয়ে পলাতক হন। ঘটনার পর লিটন ও বারেক গ্রেপ্তার হয়ে জামিন পান। তবে, দীর্ঘদিন তারা আদালতে হাজিরা দিলেও এখন তারা লাপাত্তা। আদালতসংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা জানান, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাদী আদালতে আসেন না। মামলার খোঁজ নেন না।
ইতিমধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান এক আদেশে বলেছেন, আগামী ১৩ এপ্রিলের মধ্যে কোনো সাক্ষী না এলে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করে বিচার হবে। আদালত বলে, মামলাটি ২০০২ সালের ৩ জানুয়ারি চালু হয়েছে। দীর্ঘ সময় প্রায় ২২ বছরের মধ্যে প্রসিকিউশন পক্ষ সাতজন সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন। বাকি সাক্ষীদের জন্য এই মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিচারকসংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে বলেন, কোনো অপরাধীর বিচারের জন্য সাক্ষীর সমন বা ওয়ারেন্ট কার্যকর করার দায়ভার সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে দেওয়া হয়েছে এবং সাক্ষী হাজিরের বিষয়ে তার গাফিলতি অদক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। সাক্ষী হাজির করতে নির্দেশনা দিয়ে আদেশে বলা হয়, ‘সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থ হলে অত্র মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করে গৃহীত সাক্ষীদের ওপর ভিত্তি করে মামলার বিচার করা হবে। সে ক্ষেত্রে মামলার বিরূপ প্রভাব ও দায়ভার প্রসিকিউশনপক্ষের ওপর বর্তাবে।’
জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মো. এরশাদ আলম জর্জ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাক্ষী না এলে সংগত কারণে বিচারক আইনের বিধান অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও তাই হতে চলেছে। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের মামলায় সমন পাঠালেও অনেক ক্ষেত্রে বাদী নিজেও আসেন না। অন্য সাক্ষীদের সমন দিলে ঠিকানায় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সমন ফেরত আসে। আবার অনেকে সাক্ষ্য দিতে আসেন। কিন্তু আদালতের পরিবেশে ভড়কে যান।’
বছরে গড়ে ১২০০এর বেশি ধর্ষণ
সম্প্রতি নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানমূলক তথ্য প্রকাশ করেছে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএস)। গণমাধ্যম ও নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ১১ হাজার ৭৫৮ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ৬ হাজার ৩০৫ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৮৯ জন নারী ও শিশু। অর্থাৎ প্রতিবছরে গড়ে ১ হাজার ২৬১ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, যা মাসের হিসাবে ১০০ জনের বেশি। ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০৭ জনকে। যাদের মধ্যে ১১৮ জন শিশু। পাশবিক নির্যাতনের শিকার ৫০ জন আত্মহত্যা করেছে। তবে, নারী অধিকার ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। কেন না ধর্ষণের অনেক ঘটনায় লোকলজ্জার ও সম্মানহানির ভয়ে পরিবার চেপে যায়। অনেক ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়ায় না।
বিচারে বিলম্ব সাক্ষী ‘হারিয়ে যাওয়া’
ধর্ষণ মামলা প্রমাণে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলো সাক্ষী, মেডিকেল প্রতিবেদন ও আলামত। তবে, এ ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা যায় প্রায়ই। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের মুখে প্রায়ই একটি বাক্য শোনা যায়, সাক্ষী ‘হারিয়ে গেছে’। শুনতে খটকা লাগলেও এ হারিয়ে যাওয়ার মানে হলো সাক্ষীর উদ্দেশে যে সমন জারি হয়, তা কার্যকর না হওয়া। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২)(১) উপধারা অনুযায়ী সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব পুলিশের। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করে প্রসিকিউশনপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষী হাজির করা কঠিনতম কাজ। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, আদালতগুলো নারী ও শিশুবান্ধব নয়। ধর্ষণ মামলার সাক্ষ্য দিতে এসে ভুক্তভোগীকে নানা হয়রানির ও অবাঞ্ছিত অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এ ছাড়া আসামিপক্ষের ভয়ভীতি, সরকারি সাক্ষীদের (চিকিৎসক, পুলিশ) কর্মস্থলের পরিবর্তন বা বদলি, সমন জারি ও তা কার্যকরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা সাক্ষীর গরহাজিরার বড় কারণ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফাওজিয়া মোসলেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচার বিলম্বিত মানে বিচার না পাওয়ার মতো। একটা ধর্ষণ মামলা যদি ২৩ বছর চলে, তাহলে বিচার হলো কই।’ তিনি বলেন, ‘আসলে বিচারের ক্ষেত্রে দিন বেঁধে দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কেন বিচারটা বিলম্ব হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এটিও স্বল্পতম সময়ে সম্ভব হবে না। তবে, অসম্ভবও নয়।’
ফাওজিয়া মোসলেম আরও বলেন, ‘আসলে স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, তার প্রায় কিছুই নেই। সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই, আদালতে ভালো পরিবেশ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।’
নিপীড়নের দেড় লাখের বেশি মামলা ট্রাইব্যুনালগুলোয় : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধান অনুযায়ী, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে মৃত্যু, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, শিশু নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর মামলার বিচারকাজ হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৯০টির বেশি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ১ লাখ ৫১ হাজার ৩১৭টি। যার বড় একটা অংশ ধর্ষণের মামলা। দেড় লাখের বেশি মামলার মধ্যে ঢাকার ৯টি ট্রাইব্যুনালে সবচেয়ে বেশি ১৫ হাজার ২১৩ মামলা বিচারাধীন। সবচেয়ে কম ২৬৪টি মামলা বিচারাধীন পঞ্চগড়ে। বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৬০৭টি মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সমস্যা ব্রিটিশ আমলের আইনগুলোয়। এগুলো যুগোপযোগী হয়নি। আদালতগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। এমন পরিবেশে এর চেয়ে খুব বেশি ভালো কিছু আশাও করা যায় না। আইনগুলোর সংশোধন ও আদালতে বিচার উপযোগী পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন আশা করা যায় না।’