ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার প্রতিবাদ এবং এসবের সুষ্ঠু তদন্ত ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সরব শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। যারই ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবারও প্রতিবাদী নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বহু জায়গায়। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক খুন-ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা ঘটলেও তা রোধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে গণপদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি হয়। পরে পুলিশ লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে অন্তত দশ জন আহত হয়েছেন। এদিন নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতসহ ছয় দফা দাবিতে শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন রাজধানীর ৩০টি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে ওই এলাকায় কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল বন্ধ ছিল। এই দুই কর্মসূচি ছাড়াও গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ আরও অনেক জায়গায় নারী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে মিছিল, সমাবেশ, ধর্ষকের প্রতীকী ফাঁসি ও মানববন্ধনসহ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
তবে দেশজুড়ে ধর্ষণ-নারী নিপীড়নবিরোধী কর্মসূচিতে উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই নারী নির্যাতনের ঘটনা। গতকালও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী ও শিশু ধর্ষণের সাতটি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ারা বলছেন, দেশ জুড়ে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এটা ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা ও জাতীয় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই নির্যাতনের এসব ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
গতকাল বিকেলে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে গণপদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেখানে আহত শিক্ষার্থীরা হলেন গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠক সাজেদুল ইসলাম, শাকিল আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী অং মার্মা এবং অহী। এর আগে দুপুর আড়াইটায় ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ প্লাটফর্মের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে রওনা হন শিক্ষার্থীরা। মিছিল থেকে তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের পদত্যাগ চেয়ে সেøাগান দেন। বিকেল ৩টায় শাহবাগ মোড় হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পৌঁছায় গণপদযাত্রা। পরে সেখান থেকে যমুনার দিকে যেতে ডানে মোড় নিতেই ব্যারিকেড দিয়ে শিক্ষার্থীদের আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে প্রতিবাদকারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হলে পুলিশের লাঠিপেটায় গণপদযাত্রাটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এতে চার শিক্ষার্থী ও পুলিশের রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
মিছিলে অংশ নেওয়া সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের একাংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার অব্যাহত অবনতির দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি। একইসঙ্গে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মাগুরায় শিশু ধর্ষণকারীসহ সব ধর্ষণকাণ্ডের বিচার দাবি করছি।’
এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অদ্রিতা রয় বলেন, ‘যে মিছিলে সামনের সারিতে নারীরা ছিল সে মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। লাঠিচার্জ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। অনেক সময় দিয়েছি, আর সময় দেওয়ার সুযোগ নেই।’
এ ঘটনার বিষয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, ‘তারা পদযাত্রা করার কথা বলে হঠাৎ করেই প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে ঢুকে যাওয়ায় বাধা দিই এবং কোনো বক্তব্য থাকলে পাঁচজন প্রতিনিধি পাঠাতে বলি। এতে তাদের একটা পক্ষ রাজি হলেও আরেকটা পক্ষ ব্যারিকেড ভাঙতে শুরু করে এবং পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। এতে আমাদের এক এসিকে পিটিয়ে জামা ছিঁড়ে ফেলে এবং আমাদের সাত-আটজন আহত হয়।’
শিক্ষার্থীদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে বিকেলে ছাত্রফ্রন্ট নেতা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ব্যানারে বিক্ষোভ করব। ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী বাংলাদেশ প্লাটফর্মের পরবর্তী কর্মসূচি এখনো গ্রহণ করা হয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এটি ঠিক করা হবে।’
এর আগে দুপুর সোয়া ১টার দিকে ছয় দফা দাবিতে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি ও সড়ক অবরোধ করেন রাজধানীর ৩০টি কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২০ মিনিট শাহবাগ মোড় অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে আশপাশের সড়কে কিছুটা যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল থেকেই ছোট-ছোট মিছিল নিয়ে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেয় এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদ জানাতে আসা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছিল উচ্চমাধ্যমিকের। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও এতে যুক্ত হয়।
রাজধানীর বাইরেও প্রতিবাদ চলছেই : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের প্রতীকী ফাঁসি কর্মসূচি পালন করেছে। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে পালন হওয়া এ কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘ধর্ষকের প্রতীকী ফাঁসি ও দ্রোহের কবিতা পাঠ’।
নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে রাজবাড়ীতে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
মাগুরায় ধারাবাহিক বিক্ষোভ সমাবেশ করে চলেছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয়।
বরিশাল নগরীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে মহানগর মহিলা দল। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গোপালগঞ্জেও মানববন্ধন করেছে মহিলা দল।
৭ নারী-শিশু ধর্ষণের অভিযোগ : বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খেয়াং সম্প্রদায়ের ১৬ বছর বয়সী এক মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে মো. জামাল হোসেন নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে।
বগুড়ায় বাবা-ছেলে মিলে স্কুলছাত্রীকে বাড়িতে ডেকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে রাজশাহীর বাগমারায় র্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ছেলে গোপাল চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করেছে। পলাতক রয়েছে গোপালের বাবা তুলসী দাস।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৯ বছরের শিশুকে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী।
খুলনার তেরখাদা উপজেলায় গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগে মফিজ শেখ (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে হাবিবুর রহমান হাবিব (৪২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে আবদুল হান্নান মণ্ডল নামে এক চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গৃহবধূকে (১৯) ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে।
ঢাকার সাভারে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে চাচার বিরুদ্ধে।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে শর্টকোড চালুর সিদ্ধান্ত : পুলিশের ডিজিটাইজেশনে চারটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যার মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে পুলিশের হটলাইন সেবার পাশাপাশি শর্টকোড চালু অন্যতম। প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, পুলিশের সব ধরনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ কমান্ড অ্যাপ তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে সরকার। অভিযোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ইনসিডেন্টস ট্র্যাকিং সফটওয়্যার, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে শর্টকোড ও অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি), অনলাইনে কিংবা শর্টকোডের মাধ্যমে মামলা বা এফআইআরসহ বহুবিধ আধুনিকায়নের কাজও শুরু হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রতিনিধিরা