আওয়ামী লীগের পলাতক সংসদ সদস্যদের নামে আনা ল্যান্ড ক্রুজার কিনতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথম নিলামে পলাতক সংসদ সদস্যদের ২৪টি গাড়ির মূল্য সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দর উঠেছিল। কাস্টমস ঘোষিত এসব গাড়ির রিজার্ভ মূল্য ছিল ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। নিলামে রিজার্ভ মূল্যের ৬০ শতাংশ টাকা পাওয়া গেলেই এসব গাড়ি বিক্রি করা যেত। কিন্তু সেই দর না ওঠায় এখন দ্বিতীয় নিলামে উঠছে আগের ২৪টির সঙ্গে আরও ছয় সাবেক সংসদ সদস্যের গাড়ি। অর্থাৎ দ্বিতীয় নিলামে ৩০টি গাড়ি বিক্রির জন্য উঠতে যাচ্ছে। এখন এসব গাড়ির মধ্য থেকে পাঁচটি গাড়ি নিতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে এই পাঁচটি গাড়ি বন্দর কর্তৃপক্ষ পাওয়ার জন্য গত ৫ মার্চ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির সচিব ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কাস্টমস থেকে নিলামযোগ্য পাঁচটি ভিআইপি কার (ল্যান্ড ক্রুজার) কিনতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই পাঁচটি ভিআইপি কার কাস্টমস কর্তৃপক্ষের রিজার্ভ মূল্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে কেনার অনুমতি প্রদানের জন্য আবেদন করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার সাকিব হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিলাম আইন অনুযায়ী আমরা এভাবে কোনো সংস্থাকে গাড়ি দিতে পারি না। গাড়ি নিতে হলে নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে গাড়ি নিতে পারবে। আর এমপি কোটায় আনা এসব গাড়ির রিজার্ভ মূল্য ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এই টাকার ৬০ শতাংশ (৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা) দর পেলে আমরা নিলামে বিক্রি করতে পারি।
কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ কীভাবে এ গাড়ি পেতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাড়ি হলো সরকারের। সরকার চাইলে যেকোনো সংস্থাকে যেকোনো মূল্যে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে। আমাদের যে নির্দেশনা দেওয়া হবে আমরা তাই করব।
তবে এ বিষয়ে দ্বিমত ব্যক্ত করেন কাস্টমস বিডার (নিলাম ডাকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন) অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকার চাইলে এসব গাড়ি এখন কোনো সংস্থাকে বরাদ্দ দিতে পারবে না। যেহেতু এগুলো নিলামের জন্য ক্যাটালগভুক্ত হয়েছে, তাই নিলামের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দ্বিতীয় নিলামে অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ বিডার হিসেবে গাড়ি নিতে হবে।
অনলাইন প্রক্রিয়ায় নিলামের আবেদনে বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি সর্বোচ্চ বিডার না হয় তাহলে কি গাড়ি কিনতে পারবে না? এই প্রশ্নের জবাবে কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার সাকিব হোসেন বলেন, ‘দ্বিতীয় নিলামে যদি এসব গাড়ির বিপরীতে প্রথম নিলামের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া না যায়, তাহলে ৬০ শতাংশ দামে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কাছে বিক্রি করা যাবে।’ একই মন্তব্য করেন কাস্টমস বিডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব চৌধুরীও। তিনি বলেন, দ্বিতীয় নিলামের পর ৬০ শতাংশ দামে সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কাছে এসব গাড়ি বিক্রি করলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের পাঁচটি ভিআইপি গাড়ি প্রয়োজন। সরকারি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমরা পাঁচটি গাড়ি নিতে চাই।
দ্বিতীয় নিলামে পলাতক এমপিদের কতটি গাড়ি নিলামে উঠছে? এ প্রশ্নের উত্তরে নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার সাকিব হোসেন বলেন, ‘প্রথম নিলামে অবিক্রীত থাকা ২৪টি গাড়ি দ্বিতীয় নিলামে উঠবে এবং নতুন করে আরও ছয়টি গাড়ি প্রথমবারের মতো নিলামে উঠবে। এমপি কোটার মোট ৩০টি গাড়ি নিলামে উঠবে।’
পূর্বেকার প্রেক্ষাপট
এর আগে এমপিদের কোটায় আনা গাড়িগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে তা জানতে চেয়ে গত ২১ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস। ৮ ডিসেম্বর সেই চিঠির জবাবে এগুলো আমদানিকারককে সব ফি পরিশোধ করে নেওয়ার জন্য চিঠি দিতে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ১৫ দিনের মধ্যে আমদানিকারককে এসব গাড়ি ডেলিভারি নেওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে না নেওয়ায় গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এমপি কোটার ২৪টি গাড়ি প্রথম নিলামে তোলা হয়েছিল।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, সরকারের এমপি কোটার সুবিধা নিয়ে ৫০ জন এমপি শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির অনুমতি পায়। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ব্যারিস্টার সুমন, নায়ক ফেরদৌসহ আটজন গাড়ি খালাস করে নিয়ে যান। প্রথম দফায় ২৪টির সঙ্গে এখন আরও ছয়টি যুক্ত হওয়ায় ৩০টি গাড়ি নিলামে তোলা হচ্ছে।
যেসব এমপির গাড়ি নিলামে
পিরোজপুর-২-এর সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ, ময়মনসিংহ-৭-এর এবিএম আনিসুজ্জামান, বগুরা-৫-এর মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের এমপি জিন্নাত আরা হেনরি, সুনামগঞ্জ-১-এর রনজিত চন্দ্র সরকার, নেত্রকোনা-৪-এর এসপি সাজ্জাদুল হাসান, গাইবান্ধা-২-এর শাহ সারোয়ার কবির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১-এর এসএকে একরামুজ্জামান, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকু-)-এর এমপি এসএম আল মামুন, খুলনা-৩-এর এসএম কামাল হোসাইন, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)-এর মুজিবুর রহমান, নওগাঁ-৩-এর সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, সংরক্ষিত নারী আসন-১৩-এর এমপি অভিনেত্রী তারানা হালিম, ঝিনাইদহ-২-এর নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, জামালপুর-৫-এর আবুল কালাম আজাদ, সুনামগঞ্জ-৪-এর মুহাম্মদ সিদ্দিক, চট্টগ্রাম-১৫-এর আবদুল মোতালেব, সংরক্ষিত নারী আসন-১৪-এর শাম্মী আহমেদ, ময়মনসিংহ-১১-এর আবদুল ওয়াহেদ, সংরক্ষিত নারী আসন ১২-এর রুনা রেজা, যশোর-২-এর তৌহিদুজ্জামান, টাঙ্গাইল-৮ আসনের অনুপম শাহজাহান জয়, নীলফামারী-৩-এর সাদ্দাম হোসাইন পাভেল ও সংরক্ষিত নারী আসন-৩৫ ফরিদা ইয়াসমিনের গাড়ি নিলামের জন্য শেডে রয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য পলাতক এমপির গাড়িও।
এমপি কোটায় জাপান থেকে আমদানি করা এসব গাড়ির বাজার মূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। কিন্তু দ্বাদশ সংসদের সংসদ সদস্যরা বিনাশুল্কে এক থেকে দেড় কোটি টাকায় আমদানি করলেও শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পালিয়ে যাওয়ায় এসব গাড়ি ডেলিভারি নিতে পারেনি।