রোজা ফার্সি শব্দ। আরবিতে বলা হয় ‘সাওম’ বা ‘সিয়াম’। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে ‘সাওম’ ও ‘রোজা’ উভয় শব্দই ব্যবহৃত হয়। ‘সাওম’-এর আভিধানিক অর্থ কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা। পরিভাষায় সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সঙ্গে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাওম’ বা রোজা। ইসলামি বর্ষপঞ্জির নবম মাস রমজান। এটি এমন একটি মাস যার সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের রয়েছে আত্মার সম্পর্ক।
রোজা মানুষের নানাবিধ কল্যাণ বয়ে আনে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার উপকারিতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বছরে এক মাস রোজা রাখার ফলে স্বাস্থ্যের ওপর যে কল্যাণকর প্রভাব পড়ে, সে সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত বহু স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ইতিবাচক আলোচনা করেছেন। শরীরের অতিরিক্ত মেদ এবং পাকস্থলীতে জমে থাকা অনেক ক্ষতিকর উপাদান রোজা পালনের মাধ্যমে অপসারিত হয়। যা সুস্থ-সবল শরীর গঠনে খুবই প্রয়োজন। রোজার এই উপকারিতার কারণে অন্য ধর্মের অনেক লোকও রোজা রাখে। তবে তাদের রোজা অন্য সময় এবং ভিন্ন উপায়ে পালন করে থাকে। বিশিষ্ট ইংরেজ কবি আর্নল্ড রোজার মাহাত্ম্য স্বীকার করে লিখেছেন, যা সত্য তা বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে করে, ইসলাম ধর্ম মানব প্রবৃত্তিগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে প্রসার লাভ করেছে, পাশ্চাত্যের এ ধারণা অমূলক। ইসলাম ধর্মের অবশ্য পালনীয় ইবাদত মাহে রমজানের রোজাই এই ধারণার ভ্রান্তি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। মহামতি মর্মাডিউক পিকথল বলেন, সভ্যতার এই যুগে রোজার উপকারিতা সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই।
রোজা হলো ইহকাল ও পরকালের সুখ-শান্তি লাভের উপায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি ইফতার করার সময় এবং অন্যটি যখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে। (সহিহ বুখারি) রোজাদার ব্যক্তির গুনাহ মাফ চাওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে। রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজার ইফতার করার সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। (আবু দাউদ) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ইফতারের সময় বাড়ির সবাইকে সমবেত করে দোয়া করতেন। একজন রোজাদারকে ইফতার করালে অশেষ সওয়াব পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হালাল খাদ্য বা পানীয় দ্বারা কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে।
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, যিনি রমজান মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবেন তার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে রক্ষা করা হবে। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। কিন্তু সেজন্য আসল রোজাদারের সওয়াব কমানো হবে না। (বায়হাকি) এ মাসে গরিব রোজাদারদের প্রতি লক্ষ রাখা এবং শ্রমিকের শ্রম লাঘব করে দেওয়া বিশেষ সওয়াবের কাজ বলে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। রমজান পারস্পরিক সহমর্মিতার মাস। এ মাসে আল্লাহতায়ালা বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেন।
রোজা মানুষকে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সংযম, সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ও ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক মজবুত করার শিক্ষা দেয়। রমজান উপলক্ষে যে ব্যক্তি তার অধীনস্ত কর্মচারী বা দিনমজুরের প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে তাদের কাজের চাপ লঘু করবে, স্বয়ং আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর দয়াশীল হবেন। তেমনি অভিসম্পাত রয়েছে ওই সব লোকের জন্য যারা রমজান মাসকে মূল্য দেয় না। সর্বোপরি নানা ধরনের শোষণ ও অনাচারের মাধ্যমে সিয়ামের পবিত্র পরিবেশ বিঘ্নিত করে। জীবনের চূড়ান্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি হলো আল্লাহপ্রেম। যা একজন মানুষের মধ্যে সিয়ামের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। বস্তুত রমজানের রোজার ফজিলত সত্যিই অসীম ও অতুলনীয়। মহান আল্লাহর হুকুম ও রেজামন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যেই প্রকৃত রোজাদারের সার্থকতা নিহিত। এত বড় নেয়ামতে ভরপুর পুণ্যমাসে মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে রোজা পালনের তওফিক দান করুন।
সিয়াম সাধনার নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় উপকারের পাশাপাশি পার্থিব কল্যাণও উপেক্ষা করার মতো নয়। সেদিকে লক্ষ করলে রোজা শুধু ইবাদতই নয়, মানব কল্যাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে। রমজানের শিক্ষাকে যদি আমরা প্রকৃত অর্থে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি এবং সব কর্মকা-ে অনুসরণ করি, তাহলে তা হবে আমাদের জীবনে মাহে রমজানের সাধনার যথার্থ প্রতিফলন। আমাদের প্রত্যাশা সিয়াম সাধনার কল্যাণে আমরা শুদ্ধ হব, নির্মল হব এবং আল্লাহর রহমত লাভে সমর্থ হব। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে রমজানের চিরন্তন চেতনার যথার্থ প্রতিফলন হবে, এটাই একান্ত কামনা।
আসুন, আমরা যথাযথভাবে রমজানের রোজা পালন করি। তাহলে রমজান মাসে মহান আল্লাহ আমাদের জন্য যে অপরিসীম কল্যাণ রেখেছেন, তা অর্জন করতে পারব। এতে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সুন্দর হবে। মহান
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তওফিক দান করুন। আমিন।