ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে ইমান, নামাজ ও জাকাতের পরই রোজার স্থান। হাদিসে এসেছে, ‘পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। আল্লাহতায়ালাকে এক বলে স্বীকার করা, নামাজ আদায় করা, জাকাত প্রদান করা, রমজানের রোজা রাখা এবং হজ পালন করা।’ (সহিহ মুসলিম ৩২)
রমজানের পূর্ণ মাস রোজা রাখা ফরজ। রোজা এমন একটি ইবাদত, যা বাহ্যত কষ্টকর হলেও এর প্রচলন ছিল সর্বকালে। হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সব নবীর উম্মতের ওপরই তা ফরজ ছিল। অবশ্য পূর্ব যুগে রোজার ধরন ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির। রোজা রাখার পদ্ধতির ভিন্নতা ছাড়াও ফরজ রোজার সংখ্যাও বিভিন্ন রকম ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের ওপর কেবলমাত্র আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজার ফরজ বিধান আসার পর আশুরার রোজা ফরজ হওয়ার হুকুম রহিত হয়ে যায়। রোজা ফরজ হয় হিজরতের দেড় বছর পর, ১০ শাবানে। রোজা ফরজ হওয়ার পর নবী কারিম (সা.) মোট ৯টি রমজান মাস পেয়েছিলেন।
রোজার বহুবিদ হেকমত তথা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। এ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটি কথা জানা থাকা দরকার, তা হলো, আল্লাহতায়ালা হলেন মহান স্রষ্টা আর মানুষ হলো তার ক্ষুদ্র সৃষ্টি ও দাস। এ সম্পর্কের দাবি হলো, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রতিপালক যেকোনো নির্দেশ দেবেন, মানুষ সর্বদা প্রস্তুত থাকবে তা পালনের জন্য। ওই নির্দেশের হেকমত (তাৎপর্য) তার বুঝে আসুক বা না আসুক। সুতরাং আল্লাহতায়ালা যেসব ইবাদত-বন্দেগির নির্দেশ দেবেন, সেগুলোর কোনো কারণ বা তাৎপর্য জানা না থাকলেও তৎক্ষণাৎ নতশিরে তা মেনে নেওয়াই হচ্ছে বান্দার দায়িত্ব।
বলাবাহুল্য, ইসলাম নির্দেশিত কোনো ইবাদতই তাৎপর্যহীন কিংবা যুক্তিবিরোধী নয়। তবে সবকিছুর যুক্তি বা হেকমতই যে বান্দার জানা থাকবে বা বান্দার জ্ঞান-বুদ্ধি সেটাকে স্পর্শ করতে পারবে এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহতায়ালা বান্দাকে অতি সামান্য জ্ঞান দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের অতি সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরায়েল ৮৫)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশসমূহে কত হেকমত, কত কারণ এবং কত উদ্দেশ্যই থাকতে পারে, বান্দার কত কল্যাণই তাতে নিহিত থাকতে পারে। অসীম জ্ঞানের অধিকারী সেই সত্তার নির্দেশসমূহ সসীম জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কীভাবে বুঝতে পারবে! তবুও ইসলামি পণ্ডিতরা বিভিন্ন ইবাদতের বিভিন্ন ধরনের হেকমত বর্ণনা করেছেন। রোজার ব্যাপারেও বিভিন্ন হেকমতের কথা তারা বলেছেন। যদিও শরিয়তের নির্দেশ মান্য করা এসব হেকমত বুঝে আসার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তারপরও কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশে রোজার কয়েকটি হেকমত সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
আল্লাহতায়ালা মানুষের স্বভাবে যে ফেরেশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য গচ্ছিত রেখেছেন, সেটার উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন, নফস ও প্রবৃত্তির দমন ও নিবৃত্তির অন্যতম মাধ্যম রোজা। অল্পেতুষ্টি, আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও তাকওয়ার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর উন্নতি ও বিকাশে রোজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উপরন্তু রোজার মাধ্যমে মানুষ উদার ও প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়না হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ঊর্ধ্বজগৎ তথা আপন স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগসূত্র স্থাপন সক্ষম হয়।
এ ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বছরের কিছু দিন অবশ্যই পানাহার বর্জন করা উচিত। ইসলাম অনুমোদন করে এমন সমস্যা ছাড়া যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত একটি রোজা পরিত্যাগ করে সে পাপী। আর এ কারণে সে রোজার যাবতীয় কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সমাজের অনেক সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তি অকারণে, সামান্য ছুতোয় অসুস্থ হওয়ার অমূলক আশঙ্কায় রোজা পরিত্যাগ করে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
লেখক : প্রিন্সিপাল, পদুয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা, ফেনী