রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

কপাল পুড়ছে বেবিচকের ৫৪ পরামর্শকের!

আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৪ এএম

পদের নাম বিশেষ পরিদর্শক (সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন্স ইন্সপেক্টর) ফিক্সড উইং। মাসিক বেতন ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আরেকটি পদ বিশেষ পরিদর্শক (এসএমএস) । মাসিক বেতন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা। এই দুই পদের মতো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ৬০টি পরামর্শক পদ রয়েছে। আর বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৫৪ জন। এই পরামর্শক পুষতে বেবিচককে মাসে খরচ করতে হয় প্রায় কোটি টাকা।

এখন ৫৪ পরামর্শকের অনেকেরই নিয়োগের মেয়াদ শেষ হতে যচ্ছে। সম্প্রতি পরামর্শকদের নবায়ন ও আরও নিয়োগ দিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাওয়ার পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ আসছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আর নবায়ন না করতে। ফলে কর্মরত ৫৪ পরামর্শকের কপাল পুড়ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, যে কোনো সময় তারা অবসরে চলে যাবেন। সামনের দিনগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীরগতিতে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নবায়ন করা যাবে না। যাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তারা আর চাকরি পাবেন না। তাদের মধ্যে অনেকেরই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, সামনের দিনগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত ত্রিশ বছর ধরে বেসামরিক লোকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে আসছে বেবিচক। রাজনৈতিক কানেকশন বিবেচনা করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাতেও রয়েছে দুর্নীতির আশ্রয়। অযোগ্য, অদক্ষ এবং বিমান চলাচলে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা নেই এ রকম পরামর্শকও নিয়োগ পেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেবিচক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন বিভাগে বর্তমানে সিনিয়র কনসালট্যান্ট, কনসালট্যান্ট, বিশেষ পরিদর্শক, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ডিএফওআই, ডিএমই, অ্যাভিয়েশন অ্যার্টনি পদে চুক্তিভিত্তিতে ৫৪ পরামর্শক রয়েছেন। এরমধ্যে ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড  রেগুলেশনস বিভাগেই কর্মরত রয়েছেন ৪৯ জন, অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি বিভাগে চার জন ও ফাইন্যান্স বিভাগে এক জন পরামর্শক কর্মরত রয়েছেন।

জানা যায়, নিয়োগের মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া পরামর্শকদের মেয়াদ আবারও বৃদ্ধি করতে গত ছয় মাসের ব্যবধানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চার দফা চিঠি পাঠিয়েছে বেবিচক। সর্বশেষ চিঠি পাঠানো হয়েছে গত ২৩ জানুয়ারি।

এরপর গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেবিচকের চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠায় মন্ত্রণালয় । পরে মন্ত্রণালয় বেবিচককে একটি চিঠিতে জানায়, উপযুক্ত বিষয় ও সূত্রস্ত পত্রের  প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়া পরামর্শক, বিশেষ পরিদর্শক ও আইনজীবীর চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮-এ উল্লিখিত বুদ্ধিভিত্তিক ও পেশাগত সেবা ক্রয় সংক্রান্ত বিধিবিধান অনুসরণ করে নিয়োগ প্রদানের পরামর্শসহ একটি সারসংক্ষেপ উৎসে ফেরত প্রদান করা হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নবায়ন করা যাবে না। যাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তারা আর চাকরি পাবেন না। এমনকি ৫৪ পরামর্শকের কপাল পুড়ছে তা সত্য। তাদের মধ্যে অনেকেরই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরে কেউ কেউ চাকরিও পেয়েছেন। তাদের পেছনে প্রায় কোটি টাকা খরচ হয় প্রতিমাসে। এমনকি এরই মাঝে তাদের বেতনও বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ওই সময় বেতন বৃদ্ধি না করতে আমরা নিষেধ করেছিলাম। এসব পরামর্শকদের পরিবর্তে ভালো কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে পারলে রাষ্ট্রের অর্থ বেচে যায়। কিন্তু  বেবিচকের সিন্ডিকেটের কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, বছর খানেক আগে বেবিচকের বোর্ড সভায় উপস্থাপিত পরামর্শকদের বেতন বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৪ পরামর্শকের মধ্যে সাত জন ডেজিগনেটেড ফ্লাইট অপারেশনস ইন্সপেক্টর ও চার জন অ্যাভিয়েশন মেডিকেল এক্সামিনার (খণ্ডকালীন হিসেবে কর্মরত) ছাড়া বাকি সবাই সার্বক্ষণিকভাবে কর্মরত আছেন। পরামর্শকরা নিয়মিত কর্মকর্তাদের মতোই সার্বক্ষণিকভাবে দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত আছেন। তারা রেগুলেটরি ডকুমেন্ট প্রস্তুত থেকে শুরু করে নিয়মিতভাবে রেগুলেটরি অডিট সম্পন্ন করেন। তাদের নিরন্তর পরিশ্রমের ফলে বর্তমানে কর্তৃপক্ষের  রেগুলেটরি কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ২০১২ সালের ওঈঅঙ ঈড়ড়ৎফরহধঃরড়হ ঠধষরফধঃরড়হ গরংংরড়হ (ওঈঠগ) নামক অডিটে বাংলাদেশকে কালো তালিকা থেকে মুক্ত করা ও ২০১৭ সালে ওঈঅঙ অডিটে আন্তর্জাতিক মানদ-ে বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশনের রেগুলেটরি কার্যক্রমকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করার (ওঈঅঙ সেফটি  রেটিং ৭৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং সিকিউরিটি রেটিং ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হওয়া) পেছনে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এসব চুক্তিভিত্তিক পরামর্শকদের ভূমিকা রয়েছে বলে ওই সময়কার বোর্ড সভায় দাবি করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতাদের অত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

বেবিচকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেবিচকে কর্মরত পরামর্শকদের বেতন কাঠামো সর্বশেষ গত ২০১৬ সালে কর্তৃপক্ষের পর্ষদ সভায় ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সেই  বেতনের সঙ্গে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কোনো বিধান বিদ্যমান না থাকায় ২০১৬ সালের পর থেকে একই বেতনে উপর্যুক্ত চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তারা কর্মরত আছেন। গত আট বছরে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চুক্তিভিত্তিক এসব কর্মকর্তাকে বেতন বা পরামর্শক ফি বৃদ্ধি প্রয়োজন। সরকারের সব শ্রেণির নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন প্রতি বছর নির্ধারিত হারে বৃদ্ধির বিধান থাকায় তারা প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধিসহ পেনশন সুবিধা ও অন্যান্য ভাতা প্রাপ্য হন। অন্যদিকে ২০১৬ সালের পর থেকে উল্লিখিত চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের বেতন বা পরামর্শক ফি অপরিবর্তিত আছে এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি অনুমেয়, এ পর্যায়ে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদিত হলেও ভবিষ্যতে আরও চার-পাঁচ বছর বর্ধিত বেতন স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

এই প্রসঙ্গে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পরার্মশকদের বেতন আসলেই খুবই বেশি। বিশেষ পরিদর্শকের (অ্যাভিয়েশন পাবলিক হেলথ) মাসিক বেতন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক অপারেন্সের মাসিক  বেতন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশন্স ইন্সপেক্টর)-ফিক্সড উইংয়ের মাসিক বেতন পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (এসএমএস) মাসিক বেতন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (অ্যাভিয়েশন পাবলিক হেলথ) মাসিক বেতন এক লাখ ৬২ হাজার টাকা, অ্যাভিয়েশন অ্যাটর্নির মাসিক বেতন এক লাখ ১৭ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (পারসোনাল লাইসেন্সিং) মাসিক  বেতন এক লাখ ১৭ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (অপারেশন্স) মাসিক বেতন এক লাখ ১৭ হাজার টাকা, বিশেষ পরিদর্শক (অপারেশন্স)-এআইআর মাসিক বেতন এক লাখ ১৭ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলছেন, এসব নিয়োগে কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি। অযোগ্য, অদক্ষ এবং বিমান চলাচলে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা নেই এ রকম কনসালট্যান্টদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত