নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে সম্প্রতি রাস্তায় নামছে সেখানকার মানুষ। দেশটির সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ রবিবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে, তাকে স্বাগত জানানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছিলেন। নেপালের সাংবাদিকদের তথ্য অনুযায়ী, সেদিন তার অন্তত দশ হাজার সমর্থক বিমানবন্দরের প্রধান ফটকে উপস্থিত ছিলেন। রাজপ্রাসাদ খালি করা দাবিতে তারা সেøাগান দিতে থাকেন।
বিবিসি বলছে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে জনসম্মুখে প্রায় দেখা যায়নি বললেই চলে। কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় তাকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। তবে গত কয়েক মাস ধরে তিনি বেশ সক্রিয়। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, নেপালের সরকারের বিষয়ে জনগণের হতাশা রাজতন্ত্রের সমর্থকদের একটা সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তাদের কেউ কেউ বলছেন, সব কিছুর পেছনে ভারতের হাত থাকতে পারে।
গত রবিবার কাঠমান্ডুতে জ্ঞানেন্দ্র শাহকে স্বাগত জানাতে আসা সমর্থকদের ভিড়ে এক ব্যক্তি হাতে ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি লাগানো পোস্টার। জ্ঞানেন্দ্র শাহের পোস্টারের ঠিক পাশে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। এই ছবি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নেপালে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপালের (ইউনিফাইড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিষ্ণু রিজাল। জ্ঞানেন্দ্র শাহের পোস্টারের পাশে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে লিখেছেন, এটা কিন্তু ১৯৫০-এর যুগ নয়, যে সময়ে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নিতে দিল্লিতে উপস্থিত হওয়া ত্রিভুবন শাহকে আবার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল ভারত। গণআন্দোলনের পর ক্ষমতাচ্যুত জ্ঞানেন্দ্রকে আবার সিংহাসনে বসানোর জন্য লোভ না দেখালেই ভালো হবে।
বিষ্ণু রিজাল আরও লিখেছেন, যে যোগীর ছবি নিয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে, সেই যোগীই কিন্তু কুম্ভ মেলায় অংশ নেওয়ার জন্য জ্ঞানেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানাননি। যদিও ৫০ কোটি মানুষ সেখানে স্নান করেছেন।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগীর ছবি প্রসঙ্গে রিজাল বলেছেন, জ্ঞানেন্দ্র শাহ আবার রাজা হওয়ার জন্য বিদেশিদের দালালি করছেন।
রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির (আরপিপি) প্রতি জ্ঞানেন্দ্র শাহের সমর্থন রয়েছে। নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের সঙ্গে দলটির সিনিয়র সহ-সভাপতি রবীন্দ্র মিশ্র যুক্ত রয়েছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, জ্ঞানেন্দ্র শাহের পোস্টারের পাশে যোগী আদিত্যনাথের পোস্টার কীভাবে এল এবং এর অর্থই বা কী?
উত্তরে মিশ্র বলেছেন, লাখো মানুষের ভিড়ে কে কার ছবি এনেছিল তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। যোগী আদিত্যনাথের পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাত্র একজন। ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, তার নাম- প্রদীপ বিক্রম রানা।
এই ঘটনার প্রসঙ্গে অন্য এক তত্ত্বের বিষয়েও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্র মিশ্র। তিনি বলেন, এই জাতীয় প্রদর্শনের সময় এমন ছোটখাটো ঘটনা ঘটে থাকে। আমি মনে করি রাজার এজেন্ডা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যে তার ক্ষতি করতে সরকার নানা রকম কৌশল ব্যবহার করছে।
ভারতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি হলো, তারা যখন সরকারে থাকে তখন ভারতের পক্ষে থাকে এবং ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে এলে ভারতকে গালি দেয়। তারা মনে করে ভারতকে গালি দেওয়া হলো জাতীয়তাবাদ।
এদিকে, কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কিছু জায়গায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ঘোষণা করেছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, নয়ই মার্চ থেকে দুই মাসের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার আদেশ কার্যকর থাকবে।
মহারাজগঞ্জে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, শীতল নিবাস, দূতাবাস এলাকা লাইনচৌর, সিংহ দরবার, বালুওয়াতারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সংসদ ভবনের আশপাশের এলাকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এই সব জায়গায় পাঁচজনের বেশি জড়ো হতে পারবেন না। মিছিল করা বা বিক্ষোভ প্রদর্শন চলবে না।
নেপালে ২৩৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ২০০৮ সালে গণতন্ত্রে এসেছিল। ওই দেশে ১৭ বছর হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে ১১টা সরকার পরিবর্তন হয়েছে।
নেপালের গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেকেই অনেক মন্তব্য করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, যে সেখানকার নেতারা ক্ষমতার জন্য নানান ‘কারসাজি’ করতেও দ্রুত ‘দক্ষ’ হয়ে উঠেছেন।
ভারতে নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত দীপ কুমার উপাধ্যায়ের মতে, মূল সমস্যা হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারের কাছে নেপালের জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি।
দীপ কুমার উপাধ্যায় বলছেন, নেপালের রাজনৈতিক দলগুলো যদি সতর্ক না হয়, তাহলে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরও বাড়বে। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই বিষয়ে গুরুত্ব না দেয় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বিবিসি বলছে, নেপালের রাজনীতি ভারত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছে। ওই দেশে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা বলে থাকেন সেখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কাঠমান্ডুস্থিত ভারতীয় দূতাবাস থেকে।
নেপালের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের দক্ষিণপন্থি রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৬৪ সালে, নেপালের সাবেক রাজা মহেন্দ্র নাগপুরে মকর সংক্রান্তির সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস।
রাজা মহেন্দ্র এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার এই সিদ্ধান্তে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। সেই সময় আরএসএসের কমান্ড ছিল এমএস গোলওয়ালকরের হাতে। রাজা মহেন্দ্রর আগমনের কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
সাম্প্রতিক আবহে প্রশ্ন উঠছে যে নেপালে রাজতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকে ভারত কী চোখে দেখবে। এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ডেনমার্কে নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কাঠমান্ডুর ‘থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর সোশ্যাল ইনক্লুশন অ্যান্ড ফেডারেলিজম’ (সিইআইএসএফ) পরিচালনাকারী বিজয়কান্ত কর্ণের কাছে। তিনি বলছেন, ‘আমার মনে হয় না ভারত নেপালে রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো আন্দোলনকে সমর্থন করবে। জ্ঞানেন্দ্র বহুবার দিল্লি গিয়েছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সঙ্গে দেখা করেননি। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে অবশ্য জ্ঞানেন্দ্রর সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু তার নেপথ্যেও গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠের সঙ্গে রাজপরিবারের ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে।
রবীন্দ্র মিশ্রের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে জ্ঞানেন্দ্রর শাহের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎ করেন না কেন? জবাবে মিশ্র বলেন, ‘আমি জানি না ভারতের মনে কী রয়েছে। তবে আমি ক্রমাগত বলে চলেছি যে নেপালে গণতন্ত্র আসার আগে ভারতের সঙ্গে তার আরও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক ছিল।
প্রসঙ্গত, বিবাহ পঞ্চমী উপলক্ষে নেপালের জনকপুরে অবস্থিত জানকী মন্দিরে সেখানকার রাম মন্দির থেকে বরযাত্রী আসে। ইদানীং ভারতের অযোধ্যা থেকেও বরযাত্রী আসা শুরু হয়েছে। ক্রমে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে এই অনুষ্ঠান। সেখানে সমানভাবে রাজনৈতিক রংও লেগেছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও ২০১৮ সালে বরযাত্রী নিয়ে জনকপুরে গিয়েছিলেন। তাই সাবেক রাজা রাজধানীতে ফেরার দিনে যোগীর ছবি কিছু প্রশ্নের জন্ম দেবে এটাই স্বাভাবিক।