ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানো স্টেডিয়ামের চারপাশে আবহ জুড়েই ভরপুর উত্তেজনা। কেননা শহরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, রিয়াল এবং আতলেতিকো মাদ্রিদ মুখোমুখি চ্যাম্পিয়নস লিগের মহারণে। নিজের মাঠ বলে কথা, কিক-অফের প্রথম মিনিটেই তাই শক্তি জাহির করে বসে আতলেতিকো। দুর্দান্ত প্রতি আক্রমণ থেকে কনোর গ্যালাঘার বল জালে জড়িয়ে দিলেন। গোটা স্টেডিয়াম তখন উন্মাদনার এক অন্য পর্যায়ে। বুধবার রাতে ২৭ সেকেন্ডে করা গ্যালাঘারের এই গোলটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে শুধু আতলেটিকোরই নয় যেকোনো ইংরেজ ফুটবলারের করা দ্রুততম গোল। রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা হতভম্ব! ভরসা একটাই এই দল যে সহজে হার মানে না, সেই বিশ্বাস।
দ্রুতই রিয়াল সুযোগ পেয়ে যায় সমতা ফেরানোর। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র পেনাল্টি জিতলেও, ভাগ্য তার সঙ্গ দিল না। বল চলে গেল গোলপোস্টের বাইরে। ম্যাচের সময় যত গড়াচ্ছে, খেলায় উত্তেজনায় বাড়তে থাকছে। ১২০ মিনিটের অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের পর ম্যাচ শেষ হলো গ্যালাঘারের ওই এক গোলেই। প্রথম লেগে রিয়ালের স্কোর মেলালে অগ্রগামিতার ফল ২-২। বিজয়ী নির্ধারণের জন্য শুরু হয় পেনাল্টি শুটআউট।
আতলেতিকোর দ্বিতীয় শট নিতে এসে জাল ভেদ করেন আর্জেন্টাইন তারকা জুলিয়ান আলভারেজ। সবাই ভেবেছিল সহজ গোল। কিন্তু ভিডিও রিপ্লেতে দেখা গেল, তার বাম পা হালকাভাবে বল স্পর্শ করেছিল। শট নেওয়ার আগমুহূর্তে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ হারান জুলিয়ান, তাতেই বলে তার বাম পা লেগে যায়; যাকে বলে ‘ডাবল টাচ’। ফুটবলের আইনে ডাবল টাচে গোল হয় না। তাই বল জালে জড়ালেও শেষ পর্যন্ত গোল হয়নি। রেফারি সিজমন মারচিনিয়াক প্রথমে গোলের সিদ্ধান্ত দিলেও পরে ভিএআর থেকে সংকেত আসার পর তা বাতিল করেন।
আলভারেজের বাতিল হওয়া সেই গোলই ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেয়। আইএফএবির ১৪.১ নম্বর আইনে বলা আছে, ‘যদি শুটার তার শট নেওয়ার পর আবার বল স্পর্শ করেন, তাহলে সেটি অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে এবং ফ্রি-কিক দেওয়া হবে।’ যেহেতু এটি টাইব্রেকার, তাই ফ্রি-কিকের পরিবর্তে শুধু আলভারেজের গোলটি বাতিল করা হয়। আলভারেজ এই আইনটা জানতেন, তাই রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদ করেননি। আতলেতিকোর বিশ্বস্ত গোলকিপার ইয়ান ওবলাক ভাজকেজের শটটি এক অসাধারণ সেভে আশা জাগিয়েছিলেন। তবে ফুটবলে যে ‘মাদ্রিদ ম্যাজিক’ বলে কিছু আছে, তা আবারও দেখা গেল। আতলেতিকোর চতুর্থ শট নিতে আসেন মার্কোস লোরেন্তে। কিন্তু তার শট ক্রসবারে লেগে বেরিয়ে যায়!
এবার রিয়াল মাদ্রিদের সামনে সুযোগ, একমাত্র গোল করলেই তারা কোয়ার্টার ফাইনালে। শট নিতে আসেন সেই আন্তোনিও রুডিগার, যিনি গত বছর টাইব্রেকারে গোল করে ম্যানসিটিকে বিদায় করেছিলেন। গোটা স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ, সবাই অপেক্ষায়। রুডিগার শট নিলেন, ওবলাক ডান হাতে ছোঁ মেরে বলের সংস্পর্শ পেলেন বটে, কিন্তু আটকাতে পারলেন না। বল চলে গেল জালে। গোল! আর তাতেই জিতে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। আতলেতিকোর খেলোয়াড়দের মাথা নিচু হয়ে গেল হতাশায়। ম্যাচের পর কোচ দিয়েগো সিমিওনের কণ্ঠে আলভারেজের গোল বাতিল করা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকলেও শিষ্যদের প্রতি গর্ব ফুটে উঠল, ‘আমার ছেলেদের নিয়ে আমি গর্বিত। সত্যিই ওদের নিয়ে খুশি, কারণ আমরা অনুকরণীয় লড়াই দেখাতে পেরেছি। আমাদের সমর্থকরা হতাশ মনে বাড়ি ফিরেছে। তবে এটা জানে, তাদের দল নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। দারুণ একটি রাত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে এগোতে পারি। হেরে ঘরে ফিরছি, তবে শান্তিটুকু আছে (লড়াই করার)।’
রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি প্রথম দফায় চেয়েছিলেন শেষ শটটি নিতে এনদ্রিককে পাঠাতে। কিন্তু শেষমেশ রুডিগারেই আস্থা রাখেন আর সেটিই কোয়ার্টারে তুলে দেয় রিয়ালকে। আনচেলত্তি বলেন, ‘আমি এখনো মনে করি, এটা লটারির মতো। যেকোনো কিছুই হতে পারে। চেষ্টা করছি স্থির থাকতে। ব্যাপারটি যখন লটারি, তখন অস্থির হয়ে লাভ নেই।’ লটারি জেতার পর হাসিমুখে তার প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আই অ্যাম ডেড ডেড, কমপ্লিটলি।’ রিয়াল মাদ্রিদ আবারও প্রমাণ করল, চ্যাম্পিয়নস লিগ তাদের জন্য শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয় এটি তাদের ভাগ্যে লেখা এক মহাকাব্য। কোয়ার্টারের এবারও আরেক ইংলিশ ক্লাব তাদের প্রতিপক্ষ। পিএসভি আইন্দহোভেনের সঙ্গে ২-২ ড্র করলেও প্রথম লেগে ৭-১ গোলের বিশাল জয়ে শেষ আটে উঠে রিয়ালের প্রতিপক্ষ হয়েছে আর্সেনাল।