প্রায় এক দশক ধরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ইমেগো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আসছেন ক্রীড়া উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক কাজী সাবির। ক্রিকেটার, ব্যক্তি মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে তিনি লিখেছেন দেশ রূপান্তরের পাঠকদের জন্য
ভারতের ক্রিকেটে যেমন ফ্যাবুলাস ফোর, অর্থাৎ শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণ; বাংলাদেশেও আমরা জানি কারা পঞ্চপা-ব। এই ফ্যাব ফোরের মধ্যে ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের একটা মিল খুঁজে পাই। তাদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যরে তুলনায় যাচ্ছি না, তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের দিকে যদি দেখেন তাহলে দেখবেন দুজনেই একটু চুপচাপ, দুজনেই একটু লাইমলাইটের বাইরে থাকেন বা বলা যায় অন্যরা যতটা আলোকিত এই দুজন তাদের নিজ নিজ সেই দলে একটু কমই লাইমলাইটে থাকেন। রিয়াদের সঙ্গে লক্ষ্মণের চরিত্রে খুব মিল আছে এবং দুই গ্রুপে দুজনের ভূমিকাতেও খুব মিল আছে।
ক্রিকেটীয় সামর্থ্যে অন্যদের চেয়ে তারা দুজন কিছুটা পিছিয়ে আছেন, এমনটা অনেকেই বলে তবে একটা জায়গায় দারুণ মিল। তাদের দুই দেশের ক্রিকেট ইতিহাস থেকে কোনোভাবে মুছতেই পারবেন না। এত বাঘা বাঘা টেস্ট ক্রিকেটার এসেছেন ভারতের ইতিহাসে, তারপরও ইডেন গার্ডেনসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লক্ষ্মণের ২৮১ রানের ইনিংসটা হয়তো সবার ওপরেই রাখতে হবে। তেমনি রিয়াদের দুটো ইনিংস, নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আর কার্ডিফে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে সেই পার্টনারশিপ, আরও একটা নিঃসন্দেহে ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে ম্যাচটায় ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল, সেই ইনিংসটাকেও হয়তো সবার ওপরের দিকেই রাখতে হবে। রিয়াদের একটা ব্যাপার আমি মনে করি যে, ক্যারিয়ারে রান তিনি ধারাবাহিকভাবেই করেছেন। তিনি যে জায়গাটাতে ব্যাটিং করেছেন, সেই জায়গাটাতে আসলে সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেক বেশি চোখে পড়ে, সেখানে নায়ক হয়ে যাওয়ার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি খলনায়কও বনে যেতে হয়েছে। অবশ্যই সেই জায়গা কেউ একজন সব দিন সর্বোচ্চ সাফল্য পাবে না।
রিয়াদ তার ব্যক্তিগত সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা দিয়ে যতটুকু পেরেছে করেছেন। তবে আমার মনে হয় মাঠের বাইরে সমালোচনার জবাব তিনি কমই দিয়েছেন। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আমরা দেখি, যখন তরুণ ছিলেন তখন মাঠে একটু উত্তেজিত বেশি ছিলেন, তারুণ্যের স্বাভাবিক যে বহিঃপ্রকাশ সেটা দেখা গেছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরিণত হতে দেখেছি, তাকে দল যে ভূমিকাটা দিয়েছে সেটা তিনি পালন করার চেষ্টা করেছেন এবং সেটা তার চরিত্রেও ফুটে উঠেছে। বেশিরভাগ সময়েই দেখেছি যে, সমালোচনার সময়টাও তিনি চুপই থেকেছেন এবং যতটুকু পেরেছে ব্যাট দিয়েই উত্তর দিয়েছেন। হ্যাঁ একবার সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি ‘পেইন-কিলার’-এর ব্যাপারটা বলেছেন, আমি বলব এটাই স্বাভাবিক মানব চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেছেন, হয়তো বা এটা সে একটা দুর্বল মুহূর্তে বলেছে এবং এটা নিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সমালোচনা হয়েছে। এই ব্যাপারটাকে তার খ্যাতির একটা অংশই বানিয়ে ফেলা হয়েছে, যেটা আমার কাছে মনে হয় এটা ক্রিকেটার হিসেবে রিয়াদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। বরং ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তিনি চুপই থেকেছেন, সেটা দলে তার ভূমিকা বা ব্যাটিং পজিশন নিয়ে। এমনকি ২০২৩ বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেও তিনি বলেছেন যে অনেক কিছুই তিনি বলবেন কিন্তু এখন না। এটা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেক কৌতূহল তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত বা অবসর ঘোষণার পরেও রিয়াদ কিন্তু সেই কথাগুলো বলেননি। তাতেই বোঝা যায় তার মধ্যে সেই পরিমিতিবোধটা আছে।
আমাদের যারা দর্শক আছেন বা ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন, তাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে যে একজন ক্রিকেটার ৪০ বছর বয়সে খেলছেন, তার কোন জিনিসটা আমরা আসলে বাঁচিয়ে রাখব, তার কোন গুণটা পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করবে, অবশ্যই রিয়াদের ক্ষেত্রে সেটা পেইন-কিলার হতে পারে না। তার খেলার প্রতি আত্মনিবেদন, দায়বদ্ধতা এসব জায়গা তো আছেই, তারপরও মাঠে এবং মাঠের বাইরে রিয়াদ যেভাবে নিজেকে ক্যারি করেছেন, অনেক বেশি ঝকমকে চকমকে না হয়েও যে কেউ অনেক বড় ক্রিকেটার হতে পারেন, সেটা মাঠে এবং মাঠের বাইরে রিয়াদ প্রমাণ করেছেন। মাথা নিচু করেও যে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া যায় সেটা রিয়াদ করে দেখিয়েছেন। কোথাও না কোথাও আমার কাছে মনে হয় তার জন্য ‘সাইলেন্ট কিলার’-এর চেয়ে ভালো একটা বিশেষণ দরকার ছিল। একজন ক্রিকেটার যখন ১৯ বছর জাতীয় দলে খেলে ফেলেন, তখন তার কিছু হলেও অর্জন থাকে। যদিও অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে, তারপরও আমি মনে করি অর্জনটা কম না। আরও কিছু ব্যাপার দেখবেন বাংলাদেশে ক্রীড়াঙ্গনে বা অন্য অঙ্গনে, যারা বিখ্যাত হন তাদের ব্যক্তিগত জীবনও অনেক সময় প্রকাশ্যে আসে, নানা বিতর্কের অংশ হয়। এ জায়গায় রিয়াদ তার ব্যক্তিগত জীবনকে অনেকখানি আলাদা রাখতে পেরেছেন, সেটা দেখবেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গাতে রিয়াদ সেই ব্যক্তিগত জায়গাটাকে আলাদা রেখে গেছেন। আমি ২০১৫ সাল থেকে তার ব্যবস্থাপনা অংশীদার হিসেবে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি, আমি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই; রিয়াদের চেয়ে ধারাবাহিক কোনো ক্রিকেটারকে আমি দেখিনি। পাঠকদের অনেক রকম মত থাকতেই পারে, আমি যতটুকু দেখেছি, অসাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ ক্রিকেটার। মজার ব্যাপার, বিজ্ঞাপন বাজারে রিয়াদের কদর তার চারিত্রিক গুণাবলির জন্যই ছিল। ব্র্যান্ড ম্যানেজাররা রিয়াদকে নিয়েছেন রিয়াদ, রিয়াদ বলেই। অনেক সময়েই মাঠের পারফরম্যান্স ছাপিয়ে রিয়াদের ব্যক্তিগত ইমেজের জন্যই তারা রিয়াদকে বেছে নিয়েছেন। আর বাজারে একটা কথা চালু আছে, অন্যান্য ক্রিকেটারের চেয়ে রিয়াদের সঙ্গে কাজ করা সহজ। কারণ তিনি প্রফেশনাল, সময় মেনে চলেন আর কথা দিয়ে কথা রাখেন।
রিয়াদ খুব স্বার্থকভাবেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা রাখতে পেরেছেন। অবসরের ঘোষণা দেওয়ার আগের দিনও তার সঙ্গে আমার কথা হয়। সেখানে তিনি অবসর নিয়ে কোনো রকম আভাসই দেননি। কেউ ভাবতে পারেন আমি হয়তো তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না, আমি মাইন্ড করলাম নাকি; আসলে গত ১০ বছর ধরে ব্যাপারটা এমনই ছিল। তিনি আমার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ, কিন্তু এই জায়গাটাতে তিনি খুবই সচেতন। এই সিদ্ধান্তের বেলায় তিনি হয়তো তার পরিবারের একান্ত কিছু মানুষের সঙ্গেই কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কাউকে জানাননি বলেই কেউ জানতে পারেননি, ফেসবুকে ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত। রিয়াদকে স্যালুট, এই কাজটা সহজ না জানি। রিয়াদ সেই কাজটা করতে পেরেছেন। ওর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা ছিল আনন্দদায়ক। এখন সামনের দিনগুলোতে কী হয়, সেটা নিয়ে আমি বেশ কৌতূহলী। আমি জানি যে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চান, সেটা কী ভূমিকায়, রিয়াদই ভালো বলতে পারবেন। আমি আশা করব বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঘুরে ফিরে যেকোনো ভূমিকায় একটা রিয়াদ আসুক।
এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট সবার জন্যই বিষাদের একটা মুহূর্ত। প্রায় দুই দশক মাহমুদউল্লাহ জাতীয় দলের অন্যতম প্রধান ভরসা ছিল। ধারাবাহিকতা ও চাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারার ক্ষমতা তাকে অমূল্য এক সম্পদে পরিণত করেছিল
ফারুক আহমেদ, বিসিবি সভাপতি
বণ্যাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন রিয়াদ ভাই। আপনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভ এবং মাঠ ও মাঠের বাইরে আপনি আমাদের অনেকের অনুপ্রেরণা। আপনার সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার স্মৃতিগুলো মনে পড়বে
তামিম ইকবাল
রিয়াদ ভাই, আপনার পাশে খেলা এবং আপনার কাছ থেকে শেখা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আপনার রেকর্ডই কথা বলে। খেলার প্রতি আপনার নিষ্ঠা, প্রাণোচ্ছ্বলতা এবং ভালোবাসার জন্য জাতি আপনার কাছে ঋণী
সাকিব আল হাসান
তোর নামের পাশে যে সংখ্যাগুলো ছাড়িয়ে তুই আমাদের কাছে আরও অনেক ওপরে। অ্যাডিলেড আর কার্ডিফে তোর সেঞ্চুরির কথা আজ আবার মনে পড়ছে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান, তোর এই অর্জন কেড়ে নিতে পারবে না কেউ
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা
এতগুলো বছর আপনার সঙ্গে মাঠ ভাগ করে নিতে পারা সত্যিকারের সম্মানের। আপনার দিকনির্দেশনা এবং অসংখ্য স্মৃতির জন্য ধন্যবাদ। জাতির জন্য আপনি যা অর্জন করেছেন, তার জন্য গর্বিত। এই অবসর উপভোগ করুন রিয়াদ ভাই
মুশফিকুর রহিম