বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সংকট নিরসনে দেশি গ্যাস সন্ধানে জোর

আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৬:৩২ এএম

বেশ কয়েক বছর ধরেই গ্যাস সংকট চলছে, এখন প্রকট হয়েছে। সংকট লাঘবে দেশি গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা পরিকল্পনাধীন ১০০টি কূপ খনন প্রকল্প থেকে জরুরি ভিত্তিতে এ বছরই অন্তত সাতটি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। পুরনো কিছু গ্যাস কূপের ওয়ার্কওভারও করা হবে।

উপরন্তু পার্বত্য এলাকার পাহাড়ে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অন-শোর ব্লকে পিএসসির (গ্যাসের উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) খসড়া চূড়ান্ত করে এনেছে পেট্রোবাংলা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়াতেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে চারটি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারই সে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও যেতে পারেনি। ফলে পুরনো কূপগুলোতে গ্যাসের মজুদ কমছে। একসময় দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক ২৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এখন তা নেমে এসেছে ১৮৭ কোটিতে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন দেশি গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা করে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবল ঝোঁকের কারণে গ্যাসসংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। লেগে থাকলে এ সংকট সমাধানে সফলতা আসবেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কূপে গ্যাস না পাওয়া গেলে পরেরটা থেকে বিরত থাকা যাবে না। চেষ্টা চালাতে হবে। তবেই সফলতা মিলবে। ভারতের উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, রাজস্থানে ইউনোকল টানা ১৩টি কূপ গ্যাসশূন্য পায়। এরপর কোম্পানির সদর দপ্তর বলেছিল আর কূপ খনন না করতে, কিন্তু জিওলজিস্ট অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে ১৪ নম্বর কূপ খনন করে ভারতের সবচেয়ে বড় গ্যাসখনি আবিষ্কার করেছে।

ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনুসন্ধানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সরকারের আরও আগেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। তবে দেরি হলেও এটা ভালো উদ্যোগ। দেশের জ্বালানি সংকট নিরসনে এর কোনো বিকল্প নেই।’

এক-দুটি কূপ খনন করে গ্যাস না মিললে হতাশ হওয়ার কারণ নেই উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে এমনও নজির আছে যেখানে ১০-১২টা কূপ খননের পরও তেল-গ্যাসের সন্ধান মেলেনি। কিন্তু পরে সেখানে যে তেল-গ্যাস পাওয়া গেছে তাতে দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। একটি কূপের গ্যাস দিয়েই আগের কূপগুলোতে ব্যয়ের কয়েকগুণ উঠে এসেছে।’ যেখানে গ্যাসের সম্ভাবনা বেশি সে এলাকাতে একের পর এক কূপ খননের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

পেট্রোবাংলা সূত্রমতে, গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসবের ৬৯টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ আর ৩১টি পুরাতন কূপের ওয়ার্কওভার। ওই প্রকল্পের মধ্যে রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কোম্পানি বাপেক্স ৫২টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন, ৩১টি ওয়ার্কওভার; বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ৯টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন, ১২টি ওয়ার্কওভার আর সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির ৮টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন এবং ৩টি ওয়ার্কওভার কূপ করার কথা।

এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৯ হাজার ৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) ও কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে ৫ হাজার ৭২২ কোটি ও সরকারি তহবিল থেকে ১৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকাকে অর্থের উৎস ধরা হয়েছে। ২০২৬ সালে শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল তখন। এখন যেসব এলাকায় গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেসব এলাকায় কূপ খনন করা হবে।

ওই তালিকায় বাপেক্সের ৯টি এবং এসজিএফসিএল ও বিজিএফসিএলের ৫টি কূপ থাকছে বলে জানা গেছে। বাপেক্সের ৯টি কূপের জন্য পৃথক ৩টি ডিপিপি করার হচ্ছে।

বর্তমানে ৫০টি কূপ খনন প্রকল্পের কাজ চলমান, যেসবের কাজ ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। এসব কূপের মধ্যে বাপেক্সের ১৮টি কূপ রয়েছে, যার মধ্যে ১০টির খনন শেষ হয়েছে। কাজ চলছে জামালপুর কূপের, শিগগিরই শুরু হবে শ্রীকাইল-৫, সুন্দলপুর-৪ ও সুন্দলপুর সাউথ-১-এর। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ভোলা নর্থ-৩ ও ৪, শাহবাজপুর-৫ ও ৭ শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট-১ খনন প্রকল্পের। সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে জকিগঞ্জ-১ ও ২। জকিগঞ্জের জন্য এখনো ডিপিপি চূড়ান্ত করতে পারেনি বাপেক্স। থ্রি-ডি রিপোর্টের কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।

অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কর্মসূচি জোরদার করার অংশ হিসেবে ওই প্রকল্প এগিয়ে আনা হচ্ছে উল্লেখ করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বলেছেন, দেশি গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২৬-২৮ সালের জন্য নির্ধারিত ১০০টি কূপ প্রকল্প থেকে ৭টি কূপ খননের কাজ এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় ৭টি কূপ এ বছরই খনন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি কিছু কূপের ওয়ার্কওভার করা হচ্ছে।

এদিকে অন-শোর পিএসসির জন্য নিয়োগকৃত কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান উডম্যাকেঞ্জির খসড়ার ওপর কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেগুলো আপডেট করে অনুমোদনের জন্য খসড়াটি দ্রুত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জমা দেবে পেট্রোবাংলা।

অন-শোর পিএসসিতে গ্যাসের দাম এখনো চূড়ান্ত না হলেও অফশোর পিএসসির চেয়ে কম হবে বলে আভাস মিলেছে।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, খসড়ায় তিন ধরনের দরের ফর্মুলা উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বাড়লে গ্যাসের দামও বাড়বে আর কমলে দাম কমে আসবে। তবে গ্যাসের দাম ৮ ডলারের বেশি হবে না।

তিনি জানান, বাপেক্সের শেয়ার ১০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাপেক্স আগে কোনো বিনিয়োগ করবে না। গ্যাস পাওয়া গেলে তখন তারা ১০ শতাংশ মূলধন বিনিয়োগ করবে। গ্যাস পেলে মূলধন বিনিয়োগ করে মুনাফার ভাগ পাবে তারা।

বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে ১৯১৪ সালে প্রথম কূপ খনন (সীতাকু-) করে বার্মা ওয়েল কোম্পানি। এরপর ১৯২২ সালে পাথারিয়ায় কূপ খনন করে। এরপর প্রায় ১২টি কূপ খনন করা হয়েছে, সর্বশেষ কূপ খনন করা হয় হালদায় (১৯৯৮ সাল)। এর মধ্যে সেমুতাং ১, ২, ৩ ও ৪-এ গ্যাস পাওয়া গেলেও তা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। কোনো কূপে সামান্য মজুদ আবার হালদা, সেমুতাং-৫ পটিয়াতে গ্যাসের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।

সেমুতাং-৪ কূপের রিপোর্টে কেয়ান বলেছে, রিজার্ভ খুবই কম, পাইপলাইনে বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে। বিনিয়োগ তুলে আনা কষ্টকর হবে। কূপ এলাকায় একটি ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যেতে পারে।

প্রতিনিয়ত দেশের গ্যাসের উৎপাদন কমছে। ঘাটতি সামাল দিতে এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু এলএনজি আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না দুই কারণে। প্রথমত এটি ব্যয়বহুল, দ্বিতীয়ত এলএনজি আমদানির যে অবকাঠামো তাতে প্রতিদিন গড়ে সর্বোচ্চ ৯০ থেকে ৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব।

প্রতি ইউনিট এলএনজিতে দাম পড়ে ৭০ থেকে ৭১ টাকা। আর প্রতি ইউনিট দেশি গ্যাসের দাম পড়ে ৪ টাকা। এজন্য ব্লেন্ডেড প্রাইস হয় ২৪ টাকার সামান্য বেশি।

গত ২২ জানুয়ারির বৈঠকে অনুসন্ধান কূপে গ্যাস পাওয়া গেলে তা দ্রুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য এক বা একাধিক পোর্টেবল প্রসেস প্ল্যান্ট কেনার প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। যেসব প্রসেস প্ল্যান্ট রয়েছে সেগুলো প্রয়োজনে স্থানান্তর করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষেও মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা সম্পন্ন করার সময় কমিয়ে আনার জন্য কয়েকটি প্রকল্পে তা গুচ্ছ আকারে সম্পাদন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া, দেশের যেসব জায়গায় গ্যাসের বড় মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব অঞ্চলে অনুসন্ধান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।

বাপেক্সের কাছে বর্তমানে যেসব রিগ রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করে দেশি গ্যাসের বড় রিজার্ভ অনুসন্ধান করা হবে। বর্তমানে বাপেক্সের পাঁচটি রিগ রয়েছে। গভীর কূপ খননের জন্য আরও দুটি রিগ কেনার কথা ভাবছে সরকার। এজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই সভায়।

বাপেক্সের জন্য একটি ২০ হর্সপাওয়ারের রিগ কেনার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলা। ডিপ ড্রিলিংয়ের জন্য আরও একটি রিগ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি আরও বেশি কূপ খনন করা যাবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত