উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের ক্ষুদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বেলজিয়াম। দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের মতো বেলজিয়ামের মুসলিম জনসংখ্যার বেশিরভাগই তরুণ। তুরস্ক ও মরক্কোর অধিবাসীরাই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই রমজান এলেই বেলজিয়ামে তুরস্ক ও মরক্কোর সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ফলে রমজান পালিত হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। দেশটিতে সরকারিভাবে স্বীকৃত ৭৫টি মসজিদ রয়েছে। যেখানে সরকারিভাবে ইমামদের বেতন দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বেলজিয়ামে আরও কিছু মসজিদ রয়েছে, যা নির্মাণ করেছে বলকান, আফ্রিকা, এশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসা মুসলিম সম্প্রদায়।
বেলজিয়ামের মুসলিম পরিবারগুলো সাধারণত তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ইফতার করে থাকে। দিনের বেলায় ইফতারের প্রস্তুতির জন্য প্রচুর কেনাকাটা করা হয়। বাজারগুলোতে রমজানের আবহ ফুটে ওঠে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী ও মিষ্টি পাওয়া যায়। বিশেষ করে খেজুর, যা রমজানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মরক্কান মুসলমানদের বসবাসের এলাকাগুলোতে ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও উপহার সামগ্রী বিক্রি হয়, পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারও পাওয়া যায়।
বেলজিয়ামে ইসলামকে সরকারিভাবে স্বীকৃত ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং মুসলমানরা এখানে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন। প্রতিদিন মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন এবং রমজান মাসে তারাবির নামাজে পুরো কোরআনের তেলাওয়াত শোনেন। এ ছাড়াও রমজানে কোরআন ও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিধানাবলি শেখার ব্যবস্থা করা হয়।
বেলজিয়ামে বসবাসরত তুর্কিদের মধ্যে ‘রমজান পাইড’ (ইফতার করার বিশেষ রুটি) গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। আরিফ ইয়িলমাজ ৩০ বছর আগে বেলজিয়ামে এসেছিলেন। তখন থেকেই তিনি প্রতি রমজানে এই রুটি তৈরি করে আসছেন। নিজ মাতৃভূমি থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেও তিনি এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রতি রমজানের মতো এবারও তিনি সুস্বাদু পাইড রুটি তৈরি করছেন। কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও আরিফ আনন্দ পান যখন দেখেন যে শুধু তুর্কিরাই নয়, বেলজিয়ানরাও এই পাইড রুটি উপভোগ করছেন। এটি তার জন্য গর্বের বিষয় যে তিনি এই ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখতে পারছেন।
যখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন বেরিনজেন শহরসহ দেশের অন্যান্য শহরের রেস্তোরাঁগুলোতে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যারা বাড়ির বাইরে ইফতার করতে চান, তাদের জন্য এসব রেস্তোরাঁ ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে। বেলজিয়ামের মুসলমানরা একত্র হয়ে ইফতার করেন। ইফতার শেষে নামাজ আদায় করেন। নামাজের পর গরম চা পান করতে করতে আড্ডা দেন। এরপর একসঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরেন। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো বেলজিয়ামেও রমজান মাস উৎসবমুখর ও প্রাণবন্তভাবে উদযাপিত হয়। বেলজিয়ামে রমজান মাসে ইফতারসামগ্রীর চাহিদা কেমন থাকে, তা জানার জন্য সংবাদ সংস্থা দ্য ব্রাসেলস টাইমস মিডি লেমনিয়ার এলাকায় অবস্থিত ডিকরা নামক এক বেকারি-পেস্ট্রির দোকানে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে, বেকারিতে বছর জুড়ে মুখরোচক মিষ্টান্ন, ডেজার্ট ও টক জাতীয় খাবার বিক্রি হয়। তবে রমজানে এর চাহিদা আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। বেকারির কর্মচারী জিজুউ বলেন, ‘অন্য সময়ের তুলনায় রমজান মাসে ইফতারসামগ্রীর জন্য গ্রহকের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়। আমরা রোজাদার গ্রাহকদের রাজাদের মতো সম্মান দেই এবং তাদের জন্য লালগালিচা বিছিয়ে দেই। আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে তাদের সেবা করি।’ ফাতিহ ইয়িলমাজ বেলজিয়ামে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এখানেই বেড়ে উঠেছেন। বর্তমানে তিনি ওয়ালুন শহরের নামুর মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার মধুর কোরআন তেলাওয়াতের জন্য সুপরিচিত। ২৮ বছর বয়সী ফাতিহ ইয়িলমাজ বলেন, ‘আমি নামুর মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বেলজিয়ামে রমজান খুব ভালোভাবে কাটছে। আমরা মাসটি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, জোহরের পর কোরআন তেলাওয়াত, এশার আগে ইসলামি আলোচনা এবং প্রতিদিন তারাবির নামাজ আদায়ের মাধ্যমে উদযাপন করছি। এ ছাড়া আশপাশে বসবাসরত মুসলমানদের জন্য আমাদের মসজিদে ইফতারের আয়োজনও করা হয়। বেলজিয়াম জুড়ে এভাবেই রমজান পালিত হয়।’ (সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত)
আইএইচএ নিউজ থেকে ভাষান্তর আতিকুর রহমান