মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

তার লেখা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৩ এএম

শিক্ষাগুরু আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। তারা আমাদের দ্বিতীয়বার জন্ম দেন বলে সম্মানের দিক থেকে বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। পরিবারের বাইরে তারাই প্রথম আমাদের সমাজের ভালো-মন্দ নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তারা শুধু অক্ষরজ্ঞানই দান করেন না, তারা আমাদের মর্মমূলে প্রোথিত করে দেন মূল্যবোধের বীজ। সব শিক্ষকই আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র হলেও দু-একজন শিক্ষক নিজগুণে সবার থেকে প্রিয় হয়ে ওঠেন। তাদের সঙ্গে সম্পর্কটি শুধু ক্লাসরুমেই আবদ্ধ থাকে না। তারা হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার উৎস। তারাই আমাদের প্রিয় শিক্ষক।

আমার প্রিয় শিক্ষক হলেন আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মো. তোরাব আলী। যেদিন প্রথম স্কুলে যাই সেদিন স্যার আমাদের কিছুই পড়াননি। দেখতে চেয়েছিলেন হাতের লেখা। সবার হাতের লেখা দেখার পর তিনি ঘোষণা করলেন কারও হাতের লেখা ভালো নয়। হাতের লেখা সুন্দর করতে হবে। তারপর লেখাপড়া। কারণ খাতার লেখা যদি পড়াই না যায়, হাতের লেখার কারণে যদি শিক্ষকের মনে বিরক্তির উদ্রেক হয় তাহলে যতই পড়াশোনা করা হোক না কেন খাতায় নম্বর বেশি পাওয়া যাবে না। ফলে তিনি প্রথমেই আমাদের হাতের লেখা ভালো করার ক্লাস নেবেন। এই অকাট্য যুক্তি দিয়ে ঘোষণা করলেন সেই ক্লাস শুরু হবে পরদিন থেকে। আমাদের সবাইকে বলে দিলেন রুল টানা খাতা আনতে। আমরা তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। এখন বুঝি তখন খুবই ছোট ছিলাম, কিন্তু তখন মনে করতাম আমরা বড় হয়ে গেছি। স্বভাবতই, কয়েকজন শিক্ষার্থী একটু মনোক্ষুন্ন হয়েছিল যে, তাদের এখন আবার নতুন করে হাতের লেখা অনুশীলন করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু পরদিন স্যার যখন ব্লাকবোর্ডে একটি একটি করে অক্ষর লিখতে শুরু করলেন তখন আমরা তার লেখা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা হাতের লেখা দেখে নিজেদের লেখা শুধরে নিতে উৎসাহিত হলাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হাতের লেখার এই ক্লাসগুলো শুধু হাতের লেখা বিষয়ে ছিল না। এই ক্লাসগুলোতে তিনি আমাদের বলতেন পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনীয়তার কথা, পরিপাটি পোশাক পরে কারও সামনে উপস্থিত হওয়ার গুরুত্ব। বললেন, কোনটি আদব আর কোনটি করা অনুচিত। তিনি প্রায়ই বলতেন, খাতা হলো শিক্ষার্থীর মনের আয়না। আয়নায় ময়লা থাকলে মুখ ধুলেও ময়লা যায় না। অর্থাৎ, মনমানসিকতায় ভালো হলেই হবে না বরং, পরিচ্ছন্নতার চর্চার মাধ্যমে ভালোকে ছড়িয়ে দিতে হবে। হাতের লেখা শেখানোর শেষ দিকে একটি কথা বলেছিলেন, সেটি হলো, দেখে লেখার থেকে না লেখা ভালো। যে দেখে লেখে সে চুরি করে। অন্তরে এমন কালিমা রেখে পরীক্ষার খাতায় সুন্দর করে লিখে কী লাভ!

আমার মনে আছে, আমাদের পরীক্ষার সময় শিক্ষকদের গার্ড দিতে হতো বললেই চলে। এর কারণ হয়তো, তোরাব স্যারের এই কথাগুলো। তিনি কখন যে হাতের লেখা শেখানোর মাধ্যমে জীবন শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পাঠটি দিয়েছেন বুঝতেই পারিনি। পরবর্তী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ তার বলা কথাগুলো মনে এসেছে আর আমি আমার জীবনের দিকনির্দেশনা খুঁজে পেয়েছি। সে জন্যই তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত