বড় ধরনের ভূমিকম্প নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সরকারের কোনো হেলদোল নেই। বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকা শহর বর্তমানে যেভাবে রয়েছে, যদি ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়, তাহলে কত লাখ মানুষের প্রাণ যেতে পারে! আহত হবেন কেমন? সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের যে ভয়াবহতা দেখা গেল, সেটি বাংলাদেশেও শঙ্কা তৈরি করেছে। এ রকম ভূমিকম্প যদি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে অনুভূত হয়, তখন কী হবে! সবাই জানেন, সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে থাকা বাংলাদেশ ভয়ংকর ভূমিকম্প ঝুঁকির মুখোমুখি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ঘনবসতি, পুরনো অবকাঠামো এবং বিল্ডিং কোডের দুর্বল প্রয়োগ এমন আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা জানি, ভূমিকম্পে বিশে^র সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম।
ভূমিকম্পে মৃত্যুর সারি ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আলোচনায় আসছে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় থাকা ঢাকার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরটির ঝুঁকি কমাতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও কোনো উদ্যোগই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা এ তিন প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে এখানে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের মতো এলাকার অনেক স্থাপনা কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব এলাকায় একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প, ঢাকায় অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরে রবিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে, বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্প জরিপ থেকে। সেখানে নতুন অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো ভবন তো দূরের কথা, মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন হলে নতুন ভবনগুলো টিকে থাকতে পারবে না।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় চিহ্নিত ভবনগুলো ১৫ দিনের মধ্যে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর একাধিকবার চিঠি চালাচালি ও বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকারি সংস্থাগুলো। কেন পারেনি! এর কারণ কী? সংখ্যায় তারা কতজন? আর দেশের মানুষ কত? ক্ষমতার রাজনীতি কি এভাবেই কোটি মানুষের জীবনকে তুচ্ছ করে দেয়? অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিধি মেনে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি না করায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধারকাজ চালানো কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। সরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে নির্মিত ভবনগুলোর নিম্নমান বিশেষজ্ঞদের আরও চিন্তিত করে তুলেছে। তারা বলছেন, পুরনো ভবন ভাঙা কিংবা রেট্রোফিটিং যাই করা হোক না কেন, নতুনগুলোর মান ঠিক রাখতে হবে। নতুন ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ধারণার বাইরে চলে যাবে। রাজউকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোয় আমি নিজে পরিদর্শনে যাব। যেগুলোর রেট্রোফিটিং করা যায়, ভবন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তা করব। বাকিগুলোর ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সবার আগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেব।’ এ ধরনের কথা অনেকবার আমরা শুনেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপায়ে। ভূমিকম্প ঝুঁকির তীব্রতা বাড়াতে যা যা দরকার সবই ঢাকায় রয়েছে। মনে হচ্ছে, ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে বড় ধরনের ভূমিকম্প। আন্তঃদেশীয় মূল্যায়নের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার দুর্বলতাগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষায় রূপান্তর করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ কিন্তু বড় ধরনের ভূমিকম্পের অপেক্ষায় রয়েছে। অবিলম্বে জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, ভয়াবহ দৃশ্য অপেক্ষা করছে। আমরা কি সতর্ক হব?