রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ এএম

ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম রোজা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রমজানে রোজা রাখা যেমন আবশ্যক, তেমনি শারীরিক সুস্থতার জন্যও কার্যকরী একটি ব্যবস্থাপনা। রোজা মানুষকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলির শিক্ষা দেয়, যেন লোভ-লালসা পরিহার করে কামিয়াবি হাসিল করতে পারে। এর মাধ্যমে পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। আর রোজা কেবল পরকালীন জীবনের জন্যই নয়; বরং এতে যথেষ্ট পার্থিব কল্যাণও নিহিত রয়েছে। ইহলৌকিক জীবনে পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভিত মজবুত হয় রমজান মাসে। ফলে এ মাসে শান্তির ছায়ায় ঢেকে যায় পুরো সমাজ।

ভালো স্বাস্থ্য বলতে শরীর ও মনের সুস্থতাকে বোঝায়। সুস্থতা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ পক্ষ থেকে এক বিরাট নেয়ামত। দুনিয়ার সবাই চায় নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে। সব বয়সের মানুষের কামনা সুস্থ-সবল জীবন গড়া। তাই নিজের শরীর ঠিক রাখতে মানুষের দৌরাত্ম্যের কমতি নেই। শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। রোজা রাখা শরীরের জন্য কতটা প্রয়োজন তা আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে জানতে পাই। মুসলিম মনীষীদের তথ্যমতে, রোজা মানব শরীরের জন্য যথেষ্ট উপকারী বলে জানা যায়। বিশ্বজগতের মহান চিকিৎসক হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুর জাকাত আছে। শরীরের জাকাত রোজা।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো পেট। অতিরিক্ত খাদ্যাভ্যাস এড়িয়ে চলা রোগের আরোগ্যতা।’ তিনি বহুকাল পূর্বেই এমন কিছু নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন, যা গবেষণা করে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন রোগ নিরাময়ের নানা পদ্ধতি।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও গবেষণার যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, যদি সুস্থ থাকতে চাও, তাহলে রোজা রাখো। উপবাস থাকো। ড. আলেগ হিগই বলেছেন, ‘রোজা রাখার ফলে মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। এটা খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে।’

ডাক্তার ক্লিভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছেন ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এই পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম। কেননা তারা রোজা পালন করে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সাহরি ও ইফতারে পরিমিত খাবার খান, অতি ভোজন এড়িয়ে চলেন, তারা রোজা রাখার ফলে শুধু শারীরিকভাবেই উপকৃত হন না, বরং মানসিকভাবেও প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা অনুভব করতে থাকেন।

রোজা রাখার ক্ষেত্রে কয়েকটি সহজ ফর্মুলা যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে রোজার সমস্ত উপকার ও কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, অসময়ে ও অসম ভক্ষণ হজম প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শরীরের অধিকাংশ রোগ সৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের কারণে। এই বিবেচনায় রোজা আমাদের আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে কিছু বিষয় পরিত্যাগ করার শিক্ষা দেয়।

রোজা রাখার ফলে ইউরিক অ্যাসিড এবং রক্তের ইউরিয়ার ঝুঁকিও হ্রাস পায়। যা শরীরে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি রোগ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগের কারণ হয়ে থাকে। নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার ফলে শরীরের অঙ্গগুলো স্বাভাবিক হতে থাকে, পাচনতন্ত্রের উন্নতি হয় এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগ যেমন গ্যাস, বদহজম, লিভারের রোগ, জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি ইত্যাদি কমে যায়।

সাহরি ও ইফতার রোজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমরা যদি এটিকে সুন্নত অনুসারে পালন করি তবে তা কেবল শরীরের পক্ষেই ভালো নয়, বরং প্রভূত কল্যাণ ও সওয়াব লাভের কারণও হয়ে থাকে। খেজুর দিয়ে ইফতার করা নবীজির সুন্নত। আধুনিক গবেষণা অনুসারে, খেজুরে একাধিক ভিটামিনের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, ফসফরাসসহ অনেক দরকারি খনিজ রয়েছে, যা কেবল হৃদ, মস্তিষ্ক, লিভার, পেট ও স্নায়ুকেই মজবুত করে না, বরং শরীরে প্রচুর পরিমাণে শক্তিও সঞ্চার করে।

গ্রীষ্মকালে তুলনামূলক গরম থাকায় রোজা রাখলে পানির পিপাসা বেশি লাগে। এক্ষেত্রে মুসলিম গবেষকরা সাহরির সময় ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দুই চামচ খাঁটি মধু পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করার পরামর্শ দেন। তাতে পানির তৃষ্ণা কম হয় এবং সারা দিন প্রশান্ত থাকা যায়। ডাক্তাররা সুস্বাস্থ্যের জন্য সবসময় পরিমিত খাওয়ার পরামর্শ দেন। রমজানে পুরো এক মাস রোজা রাখার ফলে পরিমিত খাওয়ার অনুশীলন হয়ে থাকে। ইসলামেও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ও অপচয় থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

শারীরিক সুস্থতায় নামাজের ভূমিকা অপরিসীম। রমজান মাসে এশার নামাজের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করতে হয়। দীর্ঘক্ষণ এ নামাজ আদায়ের ফলে মানুষের প্রয়োজনীয় শারীরিক ব্যায়াম অনুশীলন হয়ে থাকে। সঠিক পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করলে নানারকম শারীরিক সমস্যা দূর হয় বলে জানিয়েছে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের বিংহ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। গবেষকরা বলেছেন, নামাজের মাধ্যমে অনেক রোগ-ব্যাধি নিরাময় সম্ভব। বিশেষ করে নার্ভের সমস্যা, জয়েন্টের সমস্যা, হাড়ে ব্যথা, মস্তিষ্ক-পেশি ও রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা ইত্যাদি উপশম হয়। রুকু-সেজদা ধীরে-সুস্থে সঠিকভাবে করলে এ ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়।

মোট কথা, রোজা কেবল সারাদিন উপবাস থেকে নির্ধারিত সময়ে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের নাম নয়। বরং এর দ্বারা আল্লাহতায়ালা শারীরিক বহুবিধ রোগব্যাধি থেকেও আমাদের রক্ষা করেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত