রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বিশেষ ফোর্স গঠন নিয়ে অসন্তোষ  

  • আজ বেবিচকে বিক্ষোভের ডাক
  • ১০৬৩২ সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব
  • খরচ ধরা হয়েছে ৩৯৭ কোটি টাকা 
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:২৫ এএম

দেশের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাহিনী আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বিমান ও যাত্রী-দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে অপরাধ ঠেকাতে একগুচ্ছ ব্যবস্থাও নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বন্দরে নানা অপরাধ সংঘটিত হয়, অনেক দিন ধরেই। এসব কারণে দেশে-বিদেশে বিমানের বদনাম হচ্ছে। বদনাম ঘুচানোর অনেক চেষ্টা করেও কিছু হচ্ছে না। অপরাধীরা বেপরোয়া। সোনা-ডলার পাচারসহ সব অপরাধই হচ্ছে বিমানবন্দরের আনাচে-কানাচে। অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স’ নামে একটি আলাদা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। ১০ হাজার ৬৩২ সদস্যের ৭০ ভাগ নেওয়া হবে বিমান বাহিনী থেকে। বাকি ৩০ ভাগ বেসামরিক লোকবল থেকে নেওয়া হবে। এ ফোর্স গঠনের খরচ ধরা হয়েছে ৩৯৭ কোটি ২ লাখ টাকা। এ বাহিনী নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে খোদ বেবিচকে। প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আজ সোমবার বেবিচক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশের ডাক দিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। দিন দিন অপরাধ নির্মূলের ব্যবস্থাও হালনাগাদ হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে চলতি বছরই বিএএসএফের যাত্রা শুরু হবে।’

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে দেশি-বিদেশি অন্তত ৩৭টি বিমান সংস্থা তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ৪৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল চুক্তি রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে চল্লিশ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করছে শাহজালাল, শাহ আমানত, ওসমানী বিমানবন্দরসহ অন্য বিমানবন্দরগুলোতে। কিন্তু বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো না থাকায় যাত্রীবেশী অপরাধীরা সহজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে পারছে। নানা কৌশল নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে চোরাচালান ও মানবপাচারের ঘটনায়। যাত্রী হয়রানির ঘটনা তো আছেই। লাগেজ নিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা যানবাহনের অভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা রেন্ট-এ-কারের লোকজন জেঁকে বসেছে। যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি বলা চলে।

বিশেষ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষ

বেবিচক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স (বিএএসএফ) নামের বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা সংস্থা গঠনের উদ্যোগে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ বাহিনীর গঠন বন্ধের দাবিতে আজ সোমবার বেবিচকের সদর দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরাম। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে এক-দু’দিনের মধ্যে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের নেতা মো. শহীদুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন একটি আন্তর্জাতিক সিভিল সংস্থা। সারা পৃথিবীর মতো এখানেও নিরাপদে বেসামরিক বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের কার্যাবলি অভিজ্ঞ বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই করে থাকেন। কিন্তু এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে বেবিচক। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। বেবিচক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। স্বাধীন সিভিল সংস্থা দিন দিন অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সিভিল এভিয়েশনে স্লোগান উঠেছে ‘সিভিল এভিয়েশনে মিলিটারি আগ্রাসন মানি না মানব না।’ 

দীর্ঘদিনের চেষ্টায় গঠিত হচ্ছে বিশেষ বাহিনী

বেবিচক সূত্র জানায়, সিভিল এভিয়েশনের এ ধরনের সিকিউরিটি ফোর্স গঠনে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চলছিল। এবার তা পরিপূর্ণ রূপ পাবে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অভ্যন্তরীণ সব বিমানবন্দরে বেবিচকের নিজস্ব সংস্থা কাজ করবে। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন এ সংস্থাটি সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে থাকবে। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্সের জনবল হবে ১০ হাজার ৬৩২ জন। ৭০ শতাংশই নেওয়া হবে বিমানবাহিনী থেকে। বাকি ৩০ ভাগ হবে বেসামরিক লোকবল। ফোর্স গঠনের খরচ ধরা হয়েছে ৩৯৭ কোটি ২ লাখ টাকা।

গত সপ্তাহে হঠাৎ বেবিচকের চিঠি

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেবিচকের তত্ত্বাবধানে নিজস্ব এ সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের লক্ষ্যে গত সপ্তাহে হঠাৎ বেবিচকের প্রশাসন বিভাগে চিঠি দিয়েছে নিরাপত্তা বিভাগ। চিঠিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক বিধি প্রতিপালনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান এভিয়েশন শিল্পের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বেবিচকের এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক) সদস্যদের মাধ্যমে বিমানবন্দরের টার্মিনালসমূহের নিরাপত্তা নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরসহ রানওয়ে, অ্যাপ্রোন ও অনুষঙ্গিক সংবেদনশীল অভ্যন্তরীণ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অস্থায়ী এ সংস্থার সদস্যরা কার্যকর ভূমিকা পালনে পুরোপুরি সফল নন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচকের তত্ত্বাবধানে একটি নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স গঠন করা হলে সীমানা প্রাচীরসহ রানওয়ের অনুষঙ্গিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং এভিয়েশন খাতের আন্তর্জাতিক বিধি প্রতিপালন ও বিমানবন্দরসমূহের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদারকরণের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস, পর্যটক, জনশক্তি রপ্তানি প্রভৃতি বিষয়ে ও বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এ ফোর্স এভিয়েশন সিকিউরিটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। জনবলের মধ্যে ৫ হাজার ১৬৭ জন শাহজালালে, ৯৫৯ জন করে ওসমানী, শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে ২ হাজার ৮৭৭ জন দায়িত্ব পালন করবেন। অভ্যন্তরীণ চারটি বিমানবন্দর যশোর, রাজশাহী, বরিশাল ও সৈয়দপুরে ৫৬০ জন করে মোট ২ হাজার ২৪০ জন দায়িত্ব পালন করবে । তিন ধাপে এ জনবল পূরণ করা হবে। প্রথম ধাপে নিয়োগ করা হবে ৩ হাজার ৮৯৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩ হাজার ৪০৭ জন এবং তৃতীয় ধাপে ৩ হাজার ৩৩১ জন।

গোপনে প্রস্তাব পাঠানোর অভিযোগ

নাম প্রকাশ না করে বিক্ষুব্ধ বেবিচক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, বেবিচকের নিজস্ব শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে গোপনে বিশেষ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আইসিএওসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী। এমন প্রস্তাব জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ৭ দশমিক ২৫-এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের সবকটি বিমানবন্দরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না তা সত্য। সিভিল এভিয়েশন ও বাংলাদেশ বিমানের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল সংগ্রহ করা হয়েছে। তারা নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। গোয়েন্দারা প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। বিমানবন্দরের স্ক্যানিং তল্লাশির সক্ষমতা বাড়ানোসহ যাত্রী ও কার্গোর নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা আরও বাড়াতে ইডিএস, ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন ফর কেবিন উইথ ট্রে রিটার্ন সিস্টেম, আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং মেশিন ও এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেক্টর (ইডিটি), লিকুইড এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম ও ডাবল ক্যাব পিকআপ, ইটিভি কনসুমাবেলস ফর এক্সপ্লোসিভ ট্রান্স ডিটেক্টর মেশিন সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’ 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত