শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ট্রাম্পের মান রাখবেন পুতিন!

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৮ এএম

তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার অভিযান শুরুর পর থেকে এখনো কোনো যুদ্ধবিরতি দেখা যায়নি অঞ্চলটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় মস্কোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল কিয়েভ। তবে সবশেষ নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর থেকে দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। দীর্ঘ এ যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প-জেলেনস্কির তীব্র বাগবিত-াও হয়েছে, যা বিস্মিত করেছে বিশ্ব সম্প্রদায়কে। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া উভয় দেশকে ৩০ দিনের একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তবতা মেনে ইউক্রেনে সে প্রস্তাবে রাজি থাকার কথা জানিয়েছে। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এখনো মস্কোর অবস্থান স্পষ্ট করেননি। চলমান এ যুদ্ধের অবসানে আজ মঙ্গলবার পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন ট্রাম্প। সে আলোচনার পর এ সংঘাতের ভবিষ্যৎ অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। সে বৈঠকের পরই ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পরের ধাপ নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও।

ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আজ মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। রবিবার গভীর রাতে ফ্লোরিডা থেকে ওয়াশিংটনের কাছে জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রুজ বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার পথে এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনার পর ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান নিয়ে ট্রাম্প বলেন, সপ্তাহান্তে এ বিষয়ে অনেক কাজ করা হয়েছে। আমরা দেখতে চাই, এ যুদ্ধের অবসান ঘটানো সম্ভব হয় কি না। হয়তো পারব, হয়তো পারব না, কিন্তু আমি মনে করি আমাদের খুব ভালো সম্ভাবনা আছে।

গত সপ্তাহে জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাময়িক এ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সায় দেয় ইউক্রেন। এরপর গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনের প্রস্তাবে সমর্থন করেন পুতিনও। তাতে দ্রুতই অঞ্চলটিতে সংঘাত থামার প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। তবে সেখানে কিছু শর্ত জুড়ে দেন পুতিন। গত কয়েক দিন রাশিয়া ও ইউক্রেন একে অন্যের ওপর ব্যাপকমাত্রায় বিমান হামলার ঘটনায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল কুরস্ক থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বিতাড়িত করার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় আলোচনার টেবিলে মস্কোই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বলে মনে করছে সমর বিশ্লেষকরা। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে আলোচনার বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, আমার ধারণা আমরা ভূখণ্ড নিয়ে কথা বলব, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নিয়ে কথা বলব। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় কোন কোন বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে তা জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, আমি মনে করি ইউক্রেন-রাশিয়া উভয়পক্ষের মধ্যে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। আমরা এখনো এগুলো নিয়ে কথা বলছি, কিছু সম্পদ ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়ও আছে।

মার্কো রুবিও-সের্গেই লাভরভের ফোনালাপ

ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পরের ধাপ নিয়ে আলোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। মস্কো জানিয়েছে, রবিবার মার্কো রুবিও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভকে ফোন করেন। এ ফোনালাপে গত মাসে সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের বৈঠক থেকে সমঝোতার জন্য যে সুনির্দিষ্ট দিকগুলো চিহ্নিত করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর গত ফেব্রুয়ারিতে রিয়াদে দুপক্ষের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, লাভরভ ও রুবিও যোগাযোগের পথ খুলে রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মুখপাত্র টামি ব্রুস গত শনিবার বলেছিলেন, রুবিও-লাভরভ ইউক্রেন নিয়ে পরবর্তী ধাপের আলোচনা শুরু করেছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ চালিয়ে যেতেও সম্মত হয়েছেন।

ইউরোপের প্রতিক্রিয়া

রাশিয়াকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে নিঃশর্ত রাজি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা। ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার করতে ইউরোপের ২৬ নেতাকে নিয়ে ভার্চুয়াল সম্মেলন করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। সম্মেলনে ইউক্রেনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন তারা। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হলে সেখানে ইউরোপের করণীয় বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়। এ সময় মস্কোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজের সমর্থনের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। কিয়ার স্টারমার বলেন, পুতিনকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করা হবে। পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে বর্বর হামলার নিন্দাও করেন তিনি।

রাশিয়ার শর্ত

ইউক্রেনকে কোনোভাবেই সামরিক জোট ন্যাটোর অংশ করা যাবে না, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়া এমনই শর্ত দিয়েছে বলে জানা গেছে। রাশিয়ার একটি গণমাধ্যমে দেশটির সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দুটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এক. ইউক্রেনকে কোনোভাবেই ন্যাটোর অংশ করা যাবে না এবং দুই. যেকোনো শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার গ্রুশকো জানিয়েছেন, আমরা আশা করব এ শান্তিচুক্তিতে নিরাপত্তার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে এবং সেজন্যই ইউক্রেনকে এ আলোচনায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেনে ন্যাটো কোনোরকম কাজ করতে পারবে না। এমনকি ন্যাটোর সেনাও ইউক্রেনে থাকতে পারবে না। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তারা একটি বিষয়ে সম্পূর্ণ দ্বিমত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় ইউক্রেনে ন্যাটোর শান্তি সেনা মোতায়েন করতে। কিন্তু রাশিয়া কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না।

প্রসঙ্গত, ইউক্রেনে শান্তিসেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। দুই দেশই জানিয়েছিল, এটিই হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি। কিন্তু রাশিয়ার আপত্তি ঠিক এ জায়গাতেই।

বস্তুত, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানের এ পরিকল্পনাকে বোকা বলে সম্বোধন করেছেন রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার গ্রুশকো। তিনি বলেন, ন্যাটো সেনাদের যদি ইউক্রেনে মোতায়েন করা হয়, তাহলে রাশিয়া ধরে নেবে এবার তাদের যুদ্ধ ন্যাটোর সঙ্গে।

অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ বলেছেন, ইউক্রেনকে দুটি ত্যাগ স্বীকার করতে হতে পারে। রাশিয়া তাদের যে ভূখণ্ড দখল করেছে, তা ছেড়ে দিতে হতে পারে এবং ন্যাটোয় যোগ দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হতে পারে। এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াল্টজ জানিয়েছেন, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি ইউক্রেনকে সম্ভবত পুরোপুরি ভুলে যেতে হবে। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্ভব নয়। এদিকে রাশিয়া জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল অধিগ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল এখন মস্কোর দখলে। জাপোরিঝিয়া ও খেরসনেও রাশিয়ার সেনা আছে। দখলকৃত এসব অঞ্চলের বিনিময়ে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে যেতে রাজি মস্কো। ঠিক এভাবেই একসময় ক্রিমিয়াকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল ইউক্রেনকে।

রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রশাসনের দীর্ঘদিনের পুরনো নীতি থেকে সরে এসে মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করা বেশি কঠিন। গত মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্প একটি উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠক করেছেন। সেদিন পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগেই ইউক্রেনীয় নেতা হোয়াইট হাউজ থেকে বের হয়ে যান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে ইউক্রেনের সম্মতি দেওয়ায় এখন ট্রাম্পের দাবি মেনে নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি রাশিয়ার ওপর নির্ভর করছে। অতীতে অনেকবার পুতিনের ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন তিনি। এমনকি দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই বলেছিলেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকলে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুই হতো না। এবার দেখার পালা ট্রাম্পের এ আস্থার মান পুতিন রাখেন কি না!

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত