বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

নিভৃতচারী এক আলেম

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৯ এএম

ময়মনসিংহের নেত্রকোনার অন্যতম প্রধান আলেম মাওলানা আহমাদ হোসাইন। একাধারে তিনি পীরে কামেল, শাইখুল হাদিস, হাজারো আলেমের ওস্তাদ, লাখো মানুষের আধ্যাত্মিক রাহবার, ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া কওমিয়া দারুল উলুম সেহলা, পূর্বধলা, নেত্রকোনার মুহতামিম। এলাকায় ‘শায়েখে সেহলা’ নামেই তিনি পরিচিত। ইলমে ওহির মসনদে তিনি অত্যুজ্জ্বল। নিভৃতচারী বুজুর্গ। পার্থিব দুনিয়ার কোনো মোহ নেই তার মধ্যে। কিতাব অধ্যয়ন, ছাত্র গড়া ও আধ্যাত্মিকতার চর্চায় কাটছে তার জীবন।

হাজারো পথভোলা মানুষকে তিনি সঠিক পথের দিশা দিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে যেমন ইলমে হাদিসের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে নিভৃতচারিতা ও বুজুর্গিতে অতুলনীয় হয়ে আছেন নেত্রকোনার এই মহান বুজুর্গ। প্রায় শতবর্ষী এই নন্দিত আলেম নিভৃত পল্লীতে থেকে বিশুদ্ধ ইলমের পাঠদানের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির কাজ করে আসছেন অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। সহিহ বুখারির দরস প্রদান করে আসছেন কয়েক যুগ ধরে।

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হোগলা ইউনিয়নের দামপাড়া গ্রামে আনুমানিক ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথমে স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। পরে উপজেলার ঘাগড়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ইলমে ওহির প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে সেখান থেকে নিজ এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেহলা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বালিয়া মাদ্রাসায় চলে যান। দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন সোহাগী মাদ্রাসা থেকে।

শিক্ষাজীবন শেষে তারাকান্দা উপজেলার টিলাটিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এখানে থাকা অবস্থায় তার অসাধারণ অধ্যাপনার সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার পাঠদান পদ্ধতি ও বিচক্ষণতা সবার দৃষ্টি কাড়ে। শিক্ষকতার অল্পদিনেই তিনি সবার আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন। ফলে সাফল্যের ক্রমোন্নতি তাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

টিলাটিয়া মাদ্রাসা থেকে তিনি নেত্রকোনার জামিয়া কওমিয়া দারুল উলুম সেহলায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে নিয়োগের পর নিরবচ্ছিন্নভাবে হাদিস, ফিকহসহ অন্যান্য কিতাবের পাঠদান শুরু করেন। বর্তমানে তিনি এই মাদ্রাসার প্রধান শায়খুল হাদিস ও প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে আত্মশুদ্ধির কাজও করছেন। তার আধ্যাত্মিক রাহবার ছিলেন ময়মনসিংহ বড় মসজিদের ইমাম মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)। তার কাছ থেকে খেলাফতও লাভ করেন। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় তার হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অসংখ্য মুরিদ রয়েছে।

সেহলা মাদ্রাসার জীর্ণশীর্ণ ভবনকে আধুনিক ভবনে রূপদান করার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। এছাড়াও তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বহু মসজিদ-মাদ্রাসা।

তিনি আট পুত্র ও চার কন্যার জনক। ব্যক্তিজীবনে সাদামাটা ও সরলভাবে চলতে অভ্যস্ত তিনি। সুনাম সুখ্যাতির পেছনে ছুটে চলা, লৌকিকতা তার ভীষণ অপছন্দ। তিনি বরাবরই সদালাপি ও মিশুক। ভদ্রতা, সামাজিকতা ও সৌজন্যতায় অনন্য। ইসলামি রাজনীতির সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

নিভৃতচারী প্রবীণ এ আলেম বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন। কয়েক দিন আগে ময়মনসিংহের বেসরকারি একটি হাসপাতালের আইসিইউতে নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। পরে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ শাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, প্রেসার ও পায়ের সমস্যাসহ নানা জটিল রোগে ভুগছেন। সম্প্রতি শরীরের অবস্থা আরও অবনতি হলে পুনরায় ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

তিনি হাদিসশাস্ত্রের গবেষক, বিদগ্ধ ইসলামি চিন্তাবিদ এবং আদর্শ শিক্ষক। তিনি ইলম তথা ঐশীজ্ঞানের একজন খাঁটি নায়েবে রাসুল। মহান আল্লাহ এ নশ্বর পৃথিবীতে কতিপয় মনীষীকে মানুষের কল্যাণের জন্য আলোর প্রদীপ হাতে সমাজের বুকে দাঁড় করিয়ে রাখেন, তিনি আমাদের মধ্যে তাদেরই একজন। আল্লাহতায়ালা তাকে দীর্ঘজীবী করুন। তার নির্মল ছায়া আমাদের ওপর দীর্ঘ করুন। তার জীবন শান্তি ও সুখময় হোক। তার আলোকময় জীবনের ব্যাপ্তি আরও সমৃদ্ধ হোক। আমরা দোয়া করি, তিনি যেন সুস্থতার সঙ্গে তার ইলমি ও আধ্যাত্মিকতার কাজ আরও দীর্ঘ সময় সুচারুভাবে চালিয়ে যেতে পারেন।

হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওলামায়ে কেরাম নবীদের ওয়ারিশ। আর এই মর্মেই ওলামায়ে কেরাম তাদের জীবনের একাংশে নবী ও রাসুলদের জীবনের কার্যক্রম নিজেদের ব্যক্তিজীবনে ধারণ করেন। ওয়ারিশে নবী হিসেবে উম্মতের প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে তা অবলীলায় পূর্ণ করার প্রচেষ্টা চালান। এসব যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পদচারণায় মুখরিত আমাদের এ ভূমি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত