বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চলচ্চিত্র ও ইতিহাস বিকৃতি

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৫ এএম

সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছাভা’ মারাঠা নেতা ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে বীরোচিত এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একমাত্রিক খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলচ্চিত্রের সৃজনশীল স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্য হলেও ইতিহাসের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি এবং এক পক্ষকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে অন্য পক্ষকে কালিমালিপ্ত করা এক অবিচার। এমন বিকৃত উপস্থাপনা কেবল অতীতকে ভুলভাবে চিত্রিত করে না, বরং বহুধর্মী ও বহুজাতিক ভারতীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও গভীর করে তোলে।

সম্ভাজী মহারাজের প্রকৃত চরিত্র : চলচ্চিত্রে সম্ভাজী মহারাজকে এক অসীম সাহসী নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হলেও ঐতিহাসিক দলিলপত্র তার শাসন সম্পর্কে আরও জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। সম্ভাজী, শিবাজীর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে মারাঠা সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেও, তার শাসনকাল নিষ্ঠুরতা, বিশৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি শুধু মোগলদের সঙ্গেই লড়েননি, বরং নিজ সাম্রাজ্যের ভেতরেও মারাঠা অভিজাতদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন।

সম্ভাজীর শাসনকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল লাগাতার আক্রমণ ও লুণ্ঠন, যা শুধু মোগল অধিকৃত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য রাজ্যেও বিস্তৃত হয়েছিল। তার বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট করত, যা হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলত। সম্ভবত তার সবচেয়ে বিতর্কিত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাজযাত্রীদের ওপর জলদস্যুতা। আরব সাগরে সম্ভাজী এক শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন, যা মক্কা ও মদিনাগামী হাজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমণ করত। এই আক্রমণ শুধু মোগলদের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ‘ছাভা’ চলচ্চিত্র সম্ভাজীকে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, সেখানে তার শাসনের এই অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।

আওরঙ্গজেব, এক ভুল বোঝা শাসক : সম্ভাজীর গৌরবগাথার বিপরীতে, ‘ছাভা’ আওরঙ্গজেবকে একপাক্ষিকভাবে নিষ্ঠুর ও ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে চিত্রিত করেছে। কিন্তু এই উপস্থাপনা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও প্রভাবশালী সম্রাটের ইতিহাসকে মাত্রাতিরিক্ত সরলীকৃত করে। আওরঙ্গজেব ছিলেন কঠোর প্রশাসক, কিন্তু তিনি ন্যায়বিচার ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থার জন্যও পরিচিত ছিলেন। তার শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি লাভ করে, যা নিছক একনায়কের পক্ষে সম্ভব হতো না।

আওরঙ্গজেবের নীতিগুলো অনেক সময় ধর্মীয় কারণের চেয়ে বাস্তববাদী ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তিনি হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যেমন রাজা জয় সিং এবং রাজা মান সিং, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী; তিনি কোরআন লিখে এবং টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা সাধারণত একনায়কদের বিলাসী জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না।

‘ছাভা’ চলচ্চিত্রে আওরঙ্গজেবকে শুধু এক নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তার শাসনামলের জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অগ্রাহ্য করেছে। এ রকম ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করে না, বরং বর্তমানেও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেয়।

সম্ভাজীর পরাজয় এবং মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার : চলচ্চিত্রটি সম্ভাজীকে আওরঙ্গজেবের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিত্রিত করেছে, যা প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মোগলদের বিরুদ্ধে সম্ভাজীর বিদ্রোহ মারাঠা অভ্যন্তরীণ কলহের দ্বারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৬৮৯ সালে সম্ভাজী মোগলদের হাতে বন্দি হন এবং আওরঙ্গজেবের আদেশে মৃত্যুদণ্ড পান। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ঘটনা ছিল না; বরং সম্ভাজীর লাগাতার বিদ্রোহ ও লুটতরাজ বন্ধ করার একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল।

সম্ভাজীর মৃত্যুর পর তার সৎভাই রাজারাম এবং পরে তার স্ত্রী তারাবাই মারাঠা প্রতিরোধের নেতৃত্ব নেন। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ১৭০৫ সালে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী মারাঠাদের পরাজিত করে। অথচ ‘ছাভা’ সম্ভাজীকে এক অজেয় বীর হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ইতিহাসের সঙ্গে বেমানান।

প্রচারমূলক এজেন্ডা : ‘ছাভা’ চলচ্চিত্রটি সম্ভাজীকে মহানায়ক ও আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক বানিয়ে এটি এক বিশেষ বর্ণনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যা সাম্প্রতিককালে আওরঙ্গাবাদের নাম পরিবর্তন করে সম্ভাজীনগর করা এবং আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের মতো ঘটনাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

চলচ্চিত্রটি মারাঠাদের কেবল মহান যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরে, কিন্তু তাদের লুণ্ঠন নীতির ভয়াবহ দিকগুলো এড়িয়ে যায়। বিশেষত, ১৭৪১-১৭৫১ সালের মধ্যে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায়। সেই সময় বর্গী নামে পরিচিত মারাঠা বাহিনী নির্বিচারে লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এটি বাংলার লোকসাহিত্যে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে, ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে...’। অথচ ‘ছাভা’ চলচ্চিত্র মারাঠাদের এই ইতিহাস সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

ইতিহাস বিকৃতির বিপদ : চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জনসাধারণের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘ছাভা’ যে ধরনের ইতিহাস বিকৃত করছে, তা কেবল অতীতের ভুল ব্যাখ্যা নয়, বরং বর্তমান সমাজেও বিভাজন সৃষ্টি করছে। ইতিহাসকে কখনোই রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি এক বহুমাত্রিক ঘটনা প্রবাহ, যেখানে ব্যক্তিত্ব, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক কৌশল একসঙ্গে মিশে থাকে। অতএব, শুধু নায়ক-খলনায়কের ছকে ইতিহাসকে সাজানো সত্যের প্রতি অবিচার।

ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে, যেখানে ইতিহাস বিতর্কিত একটি বিষয়, সেখানে ইতিহাসকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব আরও বেশি। ‘ছাভা’ হয়তো আবেগ জাগাতে পারবে, কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার দায় এড়াতে পারবে না।

ঐতিহাসিক সত্যের গুরুত্ব ও চলচ্চিত্রের দায়িত্ব : ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে না, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপনা একটি জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলে। যখন ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়, তখন তা সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি বিশেষ করে ভারতের মতো বহুধর্মী ও বহুজাতিক সমাজে অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। তারা শুধু বিনোদনের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন না, বরং তারা সমাজের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সত্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা। ইতিহাসের বিকৃতি শুধু অতীতের প্রতি অবিচার নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি।

‘ছাভা’ চলচ্চিত্রের মতো ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে ইতিহাসের বিকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের উচিত ইতিহাসের সত্যকে সম্মান করা এবং ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করা। শুধু সত্য ও সততার মাধ্যমেই আমরা একটি সুস্থ ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠন করতে পারব।

 লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত