বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ও এশিয়ায় অস্থিরতা

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০১:৪৫ এএম

ভবিষ্যদ্বাণী করা সবসময়ই কঠিন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা আরও কঠিন। কারণ, তিনি এলোমেলো কথা বলেন। তিনি বারবার অবস্থান বদল করেন। আর মনে করেন, খামখেয়ালি আচরণ করা দর-কষাকষির জন্য ভালো কৌশল। তবে তার নির্বাচনী প্রচারণার বক্তব্য, তার নিয়োগ করা ব্যক্তিদের পরিচয় আর প্রথম মেয়াদের কর্মকাণ্ড দেখে কিছুটা ধারণা করা যায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপ এবং ঘোষণা বিশ্বে ইতোমধ্যেই ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছে। এর ফলে দেশগুলো নতুন বৈশ্বিক ভূখণ্ডে চলাচলের উপায় খুঁজে বের করতে এবং ট্রাম্পের তীক্ষè ব্যবস্থাপনায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় তা নির্ধারণ করতে তৎপর হয়েছে।  তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেনসহ কয়েকটি ফ্রন্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে উল্টে দিয়েছেন। পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। তিনি ট্রান্সআটলান্টিক জোটকে পরিত্যাগ করেছেন এবং বহুপাক্ষিকতার ওপর আরও আঘাত করেছেন। বন্ধু এবং প্রতিযোগীদের ওপর তার শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ একতরফাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বব্যবস্থাকে আরও খণ্ডিত করছে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়টিকে বিঘ্নিত এবং অস্থির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটেই ইসলামাবাদ ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে কোথায় যাবে তা বিবেচনা করছে। সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ই নতুন প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আসছে। এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের মূল ভিত্তি।  যদিও এটি পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং হতাশার উৎসও বটে। এরপর থেকে ওয়াশিংটনের কাছে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় সম্পর্ক প্রায় তলানিতে পৌঁছেছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরালো হতে থাকে। এ অঞ্চলে আমেরিকাকে একটি আত্মমগ্ন ও অসঙ্গত অংশীদার এবং অনিচ্ছুক খেলোয়াড় হিসেবে দেখা হতো। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ উভয়ই পূরণ করে এমন আরও গঠনমূলক এবং স্থায়ী সম্পর্কের জন্য চীনকেই অধিক বিবেচনা করা হতো। তা সত্ত্বেও, পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অধরা প্রমাণিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ খুব কম ছিল এবং তিনি পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কোনো আগ্রহ দেখাননি। বাইডেনের সময়কালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবারও পাকিস্তান সফর করেননি, যা সম্পর্কের নিম্ন স্তরের বিষয়টির প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়। তবে সামরিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে সহায়তাকারী কয়েকটি পাকিস্তানি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। যদিও এর খুব একটা প্রভাব ছিল না। এই পদক্ষেপের সঙ্গে থাকা কঠোর বিবৃতি যা তাৎক্ষণিকভাবে ইসলামাবাদ কর্র্তৃক নিন্দা করা হয়েছিল এবং সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলেছিল। অন্যদিকে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সম্পর্ক অস্থির হয়ে ওঠে যখন তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও প্রতারণার অভিযোগ করেন। তিনি দাবি করেন, মার্কিন সহায়তায় বিলিয়ন ডলার পাওয়ার পরও আফগানিস্তানে পাকিস্তান সহায়ক নয়। তিনি জোটসহায়তা তহবিলসহ নিরাপত্তাসহায়তা স্থগিত করেন। কিন্তু ট্রাম্প যখন আফগানিস্তান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং দোহায় একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের সাহায্য চান তখন পুনরায় আলোচনা শুরু হয়।

তা ছাড়া ট্রাম্প এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনির্ধারিত এবং অর্থহীন ছিল। এটি তখনকার মতো এখনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যেখানে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিবেশে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা সম্ভব। তীব্র সম্পর্কের পরিবর্তন এবং গভীর বিচ্ছিন্নতার মধ্যে চক্রাকারে ওঠানামা করে সম্পর্ক। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো সর্বদা ভূ-রাজনৈতিক ঝড় বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরের পরাশক্তির গতিশীলতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। আমেরিকার পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ যা তার আঞ্চলিক অগ্রাধিকারগুলোকে প্রভাবিত করেছিল, তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককেও সংজ্ঞায়িত করেছিল। তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে নিরাপত্তার বিষয়গুলো সম্পর্ক নির্ধারণ করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধে যখন আমেরিকার লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমকে দমন করা, তখন পাকিস্তান আমেরিকার সবচেয়ে মিত্র হয়ে ওঠে। তারপর ১৯৭৯ সালের পর আফগানিস্তানে রাশিয়ার আক্রমণ মোকাবিলার জন্য পারস্পরিক স্বার্থ দেখা দেয়। ৯/১১-পরবর্তী তৃতীয় পর্যায়ে ছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল কায়েদাকে পরাজিত করা। পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা লাদেনকে হত্যা ও আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার প্রত্যাহারের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে। এই তিনটি পর্যায়ে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সত্ত্বেও সর্বদা সহযোগিতার দ্বার খোলা ছিল। প্রথম পর্যায়ে ছিল ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ছিল কমিউনিজমকে পরাজিত করা। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার বহিরাগত ভারসাম্য কৌশলের অংশ। শত্রু ভারতের বিশাল ক্ষমতার কারণে তার নিরাপত্তাজনিত দ্বিধা কাটাতে আঞ্চলিক সমর্থনের দরকার ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে, পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি, যদিও আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারত্বের বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রামে তারা উভয়ই সহযোগিতা করেছিল।

কিন্তু রাশিয়ার পরাজয়ের পর এই বিভেদ দেখা দেয় যখন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক ইস্যুতে ইসলামাবাদের ওপর বড় পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাকিস্তান আমেরিকার সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগের কারণে আমেরিকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ইসলামাবাদ বিশ্বাস করে যে, একদিন সবাইকে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু ওয়াশিংটন এটিকে পাকিস্তানের দ্বৈত খেলার প্রমাণ হিসেবে দেখেছিল। এই পটভূমিতে ইসলামাবাদ আমেরিকার অন্যান্য উদ্বেগের অংশ হিসেবে নয় বরং পাকিস্তানের অন্তর্নিহিত গুরুত্বের ভিত্তিতে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে চায়। কিন্তু পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের পুনর্গঠিত অগ্রাধিকারগুলোতে পাকিস্তানের স্থান নেই। অন্যান্য সীমাবদ্ধতামূলক কারণও রয়েছে। আমেরিকার শীর্ষ কৌশলগত অগ্রাধিকার হলো চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও পাকিস্তান মনে করে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। তারা চীনের সঙ্গে তার কৌশলগত ভবিষ্যৎকে নির্ভরশীল বলে মনে করে এবং কোনো চীনবিরোধী জোটের অংশ হবে না। এটি পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের জায়গাকে সীমিত করেছে। ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরার কৌশলে এই অঞ্চলে তার পছন্দের অংশীদার ভারতের সঙ্গে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও একই রকম। এই দুটি কৌশলগত বাস্তবতার মধ্যে স্থান খুঁজে পাওয়া পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। আরেকটি সীমাবদ্ধ কারণ হলো পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা যা অর্থপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ না পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে শক্তিশালী করে এবং তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার একটি পর্যায় থাকা বাঞ্ছনীয়।

আপাতত মাথা নিচু করে রাখা এমন একটি প্রশাসনে কেবল নিজস্ব নিয়ম মেনে চলতে চায়। যাদের কৌতুকপূর্ণ আচরণ অপ্রয়োজনীয় সমস্যা তৈরি করতে পারে। পাকিস্তানকেও বিকল্প হিসেবে ভাবতে হবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের জনগণও এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। ট্রাম্প হয়তো এই অঞ্চলে তার আগের সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিতে চাইবেন; কিন্তু তিনি কীভাবে তা করবেন, তা বোঝা কঠিন। ইউরোপ আর ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এক দিনে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তিনি কীভাবে যুদ্ধবিরতি আনবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। এমন হতে পারে, ট্রাম্প ইউক্রেনকে কম সহায়তা দিয়ে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবেন, যাতে ইউক্রেন রাশিয়ার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। আবার তিনি এমন সমাধানের দিকেও যেতে পারেন, যাকে কোরিয়ান সমাধান বলা হয়। এই সমাধানে, যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান সীমান্তকে নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল বানানো হবে, যেখানে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় শান্তিরক্ষীরা অবস্থান করবে। ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরনো ধারা অনুসরণ করতে চান। প্রথম উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, এখন থেকে আমেরিকার স্বার্থ থাকবে সবার আগে, আমরা কাউকে আমাদের মতো হতে বাধ্য করব না; বরং আমাদের জীবনধারাকে সবার জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে প্রদর্শন করব। এই দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বার্তা দেয় না; তবে এটি পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর নীতির দিকেও যায় না।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত