মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

যমুনা রেলসেতুর উদ্বোধন

খুলল উত্তরবঙ্গের সম্ভাবনার নতুন দ্বার

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৮ এএম

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খুলে দেওয়া হলো যমুনা রেলসেতু। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টায় সেতুর পূর্ব ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন এলাকায় পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সেতুটির উদ্বোধন করা হয়। এতে রেলপথের সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রার এক নতুন দ্বার উন্মোচন হলো। রেলপথে উত্তরবঙ্গের যাতায়াতে আগের মতো যমুনা সেতু পার হতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। এখন তিন মিনিটেই পার হওয়া যাবে এ সেতু।

গতকাল রেলওয়ের মহাপরিচালক এম আফজাল হোসেনের সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সচিব এম ফাহিমুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি ও জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি। এ সেতু উদ্বোধনের পর তারা সেতুর পূর্বপ্রান্ত থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে যমুনা সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জে সায়দাবাদ স্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করে। এর আগে উদ্বোধনী বিশেষ ট্রেনটি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার সেতু পার হয়। এতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন মিনিটেরও কম।

যমুনা রেল সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে এ প্রকল্পটির ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরে দুই বছর বাড়ানো হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দাঁড়ায়। যার মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থায়ন এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাইকা ঋণ দিয়েছে এবং বাকি অর্থ সরকার দিয়েছে। জাপানের ওটিজি ও আইএইচআই যৌথভাবে সেতুটি নির্মাণ করেছে।

১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন পারাপার হতো। এ সমস্যার সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এ সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং কাজ শুরু হয়।

সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ার রবিউল মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ আসার পর এই যমুনা সেতুতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের বেশি সময় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু এখন থেকে আর ট্রেন দাঁড়াবে না। তিন মিনিটের মধ্যে ট্রেন পাড়ি দেবে যমুনা। বিষয়টি এতদিন আমাদের কাছে স্বপ্নের মতোই ছিল।’

উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার মানুষ এ সেতুর সুফল পাবে বলে জানান দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বাসিন্দা আমিনুল হাসান। তিনি জানান, ঈদের সময় এ সেতুর জন্য আগে অনেক যানজট লেগে থাকত। কিন্তু এখন থেকে আর যানজটে বসে থাকতে হবে না। এ সেতু ব্যবহার করে উত্তরবঙ্গের মানুষ যোগাযোগের সুফল পাবে।

টাঙ্গাইলের বাসিন্দা তমিজ উদ্দীন জানান, এ সেতুর ফলে দুই পাড়সহ পুরো উত্তরবঙ্গ মানুষ অর্থনীতিতে সুফল ভোগ করবে। কারণ এখন থেকে পণ্যবাহী মালামাল এ রুট দিয়ে আনা-নেওয়া করা যাবে। আগে সেতু দুর্বল হওয়ার জন্য অনেক ভারী মালামাল এ সেতু দিয়ে বহন করা যেত না। কিন্তু এখন থেকে সব রকমের পণ্য এই ট্রেন দিয়ে বহন করা যাবে।

রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, যমুনা রেলসেতু দিয়ে ট্রেন পারাপারে আগের তুলনায় কম সময় লাগবে। এতে দুই পাড়েই সময় সাশ্রয় হবে। ডাবল লেনের সুবিধা পেতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম বলেন, সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। এর ফলে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।

এদিকে রেলপথ সচিব ফাহিমুল ইসলাম বলেন, যমুনা বহুমুখী সেতু ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেতুতে রেলের লিঙ্ক প্রয়োজন দেখা দেওয়ার পর এ সেতুতে একটি সিঙ্গেল রেলসেতু সংযোজন করা হয়েছিল। যদিও এ সেতুটি রেলের জন্য প্রথমে বানানো হয়নি। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার অনুভব করেছে এ সেতুতে একটি ডেডিকেটেড রেল ব্রিজ প্রয়োজন, সে তাগিদ থেকে এ সেতু নির্মিত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখন থেকে এই রেলসেতু দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ট্রান্সএশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক যুক্ত হওয়ার জন্য এ অঞ্চলের একটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা রয়েছে। আঞ্চলিক রেল নেটওয়ার্ক কানেকটিভিটি বাড়ানোর জন্য এ রেলসেতুটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সেতুটি পুরোপুরি ইউটিলাইজ করতে হলে ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর ডাবল লাইন হতে হবে। এটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনার মধ্যে আছে। যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধি করতে রেলওয়েতে নতুন কোচ এবং লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

যমুনা রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে রেলপথ সচিব বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। ভবিষ্যতে এলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত