রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষায় ইসলাম

আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৯ এএম

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ সমাজ ছাড়া একাকী সুন্দর ও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। তাই তার প্রয়োজন সুন্দর সমাজ ও প্রতিবেশী। একজন মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রতিবেশীর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রতিবেশীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি ইসলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেশী যারা : হাসান বসরি (রহ.)-কে প্রতিবেশী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নিজের ঘর থেকে সামনের ৪০টি, পেছনের ৪০টি, ডানের ৪০টি এবং বাঁয়ের ৪০টি ঘরের অধিবাসীরাই প্রতিবেশী।

কোরআনে প্রতিবেশীর হক : সুরা নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহর ইবাদাত এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক না করার বিধানের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হক। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও এতিমের হক। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সঙ্গেই আল্লাহ প্রতিবেশীর হককে উল্লেখ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রতিবেশীর হককে আল্লাহ কত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য

কত জরুরি।

হাদিসে প্রতিবেশীর হক : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (সহিহ বুখারি) এখানে কষ্ট না দেওয়ার অর্থ হলো, মানুষের কাছ থেকে এমন কোনো কথাবার্তা বা কাজকর্ম প্রকাশ না পাওয়া, যে কারণে তার প্রতিবেশী শারীরিক অথবা মানসিক কষ্ট পায়। কষ্ট দেওয়ার জন্য তাকে প্রহার করতে হবে ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়।

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে সর্বদাই প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করতেন। এমন কি আমি এ আশঙ্কা করতাম যে, হয়তো প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করা হবে।’ (সহিহ বুখারি)

প্রতিবেশীকে সম্মান করা ইমানের নিদর্শন : আবু শুরাইহ আদাবি (রা.) বলেন, আমি নিজ কানে শুনেছি, নিজ চোখে দেখেছি যখন রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা) এই হাদিসের অন্যতম বর্ণনাকারী আতা খোরাসানি (রহ.)-এর কাছে প্রতিবেশীর অধিকার কী কী জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যখন প্রতিবেশী সাহায্য চায়, তাকে সাহায্য করা। যখন ঋণ চায়, ঋণ দেওয়া। প্রতিবেশী দরিদ্র হলে তাকে দান করা। অসুস্থ হলে সেবা করা। ভালো কিছু অর্জন করলে তাকে অভিনন্দন জানানো। বিপদে পতিত হলে সান্ত্বনা দেওয়া। মৃত্যুবরণ করলে তার জানাজায় অংশ নেওয়া। প্রতিবেশীর অনুমতি ছাড়া ঘর এত উঁচু তৈরি না করা, যাতে প্রতিবেশীর ঘরে বাতাস প্রবেশে বিঘœ ঘটে। প্রতিবেশীকে নিজের ঘরের রান্নার ঘ্রাণ দিয়ে কষ্ট না দেওয়া, তবে তাকে খাবারের কিছু অংশ দিলে ভিন্ন কথা।’ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করা পরিপূর্ণ ইমানের নিদর্শন। এমনকি ইসলামপূর্ব যুগেও এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করার ধরন হচ্ছে, সাধ্যমতো প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করা। যেমন তাকে হাদিয়া দেওয়া, সালাম দেওয়া। তার সঙ্গে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করা। তার খোঁজখবর নেওয়া। প্রয়োজনের সময় তাকে সাহায্য করা। বাহ্যিক ও মানসিক দিক থেকে কষ্ট না দেওয়া এবং কষ্টের কারণ দূর করা।’

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া মুশরিকদের নিদর্শন : নবী করিম (সা.)-এর জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তিনি মক্কায় থাকাকালীন প্রতিবেশীরা কতই না কষ্ট দিয়েছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক। ইবনে ইসহাক বলেন, ‘মক্কার যেসব লোক রাসুল (সা.)-কে কষ্ট দিত, তারা হচ্ছে আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আস ইবনে উমাইয়া, উকবা ইবনে আবু মুঈত, আদি ইবনে হামলা সাকাফি, ইবনে আসদা হুজালি প্রমুখ। এরা ছিল রাসুল (সা.) প্রতিবেশী।’

তাদের কেউ এসে সদ্য প্রসব করা ছাগলের নাড়িভুড়ি এনে নামাজ পড়া অবস্থায় রাসুল (সা.)-এর ওপর ফেলত। রাসুল (সা.) তখন তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘হে আবদে মানাফের গোত্র, এ কোন ধরনের প্রতিবিশিত্ব?

আবু লাহাবের স্ত্রী (উম্মে জামিল) পাহাড় থেকে কাঁটাযুক্ত ডালপালা এনে রাসুল (সা.)-এর ঘরের দরজার সামনে ফেলে রাখত, যেন তিনি ঘর থেকে বের হতে না পারেন অথবা বের হওয়ার সময় যেন তার পায়ে কাঁটাবিদ্ধ হয়। আবু শুরাইহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, সেই ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম, সেই ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম সেই ব্যক্তি মুমিন নয়।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল, সেই ব্যক্তি কে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (সহিহ বুখারি)

এই হাদিস প্রমাণ করে, প্রতিবেশীর অধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ রাসুল (সা.) আল্লাহর নামে কসম করেছেন। সেই কসমও একবার নয়, বরং তিনবার কসম করে একই কথা বলেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কথায় বা আচরণে কষ্ট দেয়, তার ইমান আশঙ্কাপূর্ণ। তবে ইমান দ্বারা এখানে পূর্ণ ইমান উদ্দেশ্য। আর নিঃসন্দেহে একজন গুনাহগার পূর্ণ মুমিন নয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) সেই লোকের ইমান নিয়ে আশঙ্কা করলেন, যে তার প্রতিবেশীর অনিষ্ট সাধন করে। প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে এ কথাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রকাশক। এ হাদিস থেকে আরও বোঝা গেল, প্রতিবেশীর ক্ষতি করা কবিরা গুনাহ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘এক লোক রাসুল (সা.)-কে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এক নারী অত্যধিক নামাজ, রোজা, দানের জন্য সুপরিচিত। কিন্তু সে কথার মাধ্যমে তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। তার ব্যপারে আপনি কী বলেন? রাসুল (সা.) বললেন, সে জাহান্নামি। লোকটি আবার বলল, হে রাসুল, আরেক নারীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, সে রোজা কম রাখে, দানও কম করে এবং নামাজও কম পড়ে। বলতে গেলে সে এক টুকরা পনিরই দান করে না। কিন্তু প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। তার ব্যাপারে আপনি কী বলেন? রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, সে জান্নাতি। (আদাবুল মুফরাদ ১১৯)

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত