দ্রুত চালাও
নূরজাহান বেগম ঘড়ি দেখেন। পল্লবী থেকে বিশ মিনিটে ডিবি অফিসে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও চিপা গলিপথ ধরে, গাড়ি কাটিয়ে ১০টার মধ্যে ডিবি অফিসে পৌঁছালেন। প্রায় ৪০ মিনিট পর ডিবি অফিস থেকে বের হলেন তিনি।
তেমন কিছু হলো ম্যাডাম? জানতে চায় রুহুল।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নূরজাহান বেগম, কী আর হবে।
চিন্তা করবেন না, খুনি একদিন ধরা পড়বেই।
আমি ভেবে অবাক হই! এই ছয় মাসে গোয়েন্দারা একটা ক্লু পর্যন্ত খুঁজে পেল না, সেখানে ধরা তো অনেক দূর।
ম্যাডাম, আপনি কি নিশ্চিত যে তার অফিসের কারও হাত আছে?
নয় তো কি! তা ছাড়া আমাদের শত্রু আর কে, বলো?
হ্যাঁ, তা ঠিক।
দেখোনি, ড্রাইভারকে পর্যন্ত ছাড়েনি। খুনের সময় ও হয়তো সব দেখে ফেলেছিল।
হবে হয়তো বলে মাথা নাড়ে রুহুল আমিন। ওদের পরিবারের সঙ্গে কী আপনার যোগাযোগ আছে ম্যাডাম?
কাদের?
ড্রাইভারের।
না রে বাপু, আমি আছি আমার জ্বালায়। আর তুমি বলছো কি না... যাওয়ার সময় বাজার হয়ে যেও।
ঠিক আছে ম্যাডাম।
একটু পর নূরজাহান বেগমের নাক ডাকার শব্দ বাড়তে থাকল। গাড়িতে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। তবে আজ নাক ডাকার শব্দ একটু বেশি। হয়তো রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। তারপরও বাজারের কাছে এসে ডাকতে হলো।
ম্যাডাম চলে এসেছি।
ও আচ্ছা, চলো...
আপনি থাকেন, আমি নিয়ে আসি।
না, না চলো, গাড়ি থেকে নামলেন নূরজাহান বেগম। বাজার শেষে একটু বিরক্ত হলেন তিনি। কী ব্যাপার রুহুল, কম কম জিনিস ‘ওয়ালা দোকান থেকে বাজার করতে চাইলে!
হ্যাঁ ম্যাডাম, আমি তাই করি। ওদেরও তো পরিবার আছে। বাচ্চারা লেখাপড়া করে। দুমুঠো খাওয়াতে হয়। যদি সবাই বড় বড় দোকান থেকেই কেনে তবে ওরা বাঁচবে কীভাবে? দেখলেন না কচুর লতিওয়ালা লোকটা ৫ মুঠো লতি নিয়ে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল?
তোমার তো বাপু হাতেম তাই হওয়া উচিত ছিল, একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন নূরজাহান বেগম।
কথা বাড়ায় না রুহুল। গাড়ি চলতে থাকে।
আচ্ছা রুহুল, পুলিশ কেন কোনো ক্লো খোঁজে পাচ্ছে না?
আপনি ডিবি পুলিশদের একটু দানাপানি ছাড়েন, দেখবেন ঠিকই ক্লো খুঁজে পাবে।
দানাপানি মানে?
বুঝলেন না, ঘুষ।
দিতে চেয়েছি তো।
না, নগদে দিতে হবে। ‘দিব’ ‘চেয়েছি’ এই শব্দে পুলিশ বিশ্বাস রাখে না।
কোনো কথা বলল না নূরজাহান বেগম।
রাত ৯টায় বাসায় ফেরে রহুল। ছোট্ট একটা রুম, তিনতলায় ছাদের পাশে টিনের ছাউনিতে ঘেরা ঘরটা। দক্ষিণ-পূর্ব, পশ্চিমের সবদিক দিয়ে বাতাস এসে হামলে পড়ে। যেদিন জোছনা থাকে সেদিন আর সে রুমের ভেতর ঘুমায় না, পাটি পেতে পানির ট্যাংকির কাছেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম হয় না। বাবার নিরুপায় মুখটি এসে জাপটে ধরে। সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে ধ্বংস করে যায়। বেশ কিছুদিন আগে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল সে কিন্তু পারেনি, কারণ তার একটা দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। কারণে-অকারণে তাকে বাঁচতে হচ্ছে। হঠাৎ বিড়ালটা গা ঘেঁষে ওর ধ্যান ফেরায়। মিউ মিউ শব্দ করে। এই তো মাস-পাঁচেক হলো, সেদিন ঝড়ের রাতে পা খুঁড়িয়ে খুুঁড়িয়ে পানির ট্যাংকির কাছে থরথর করে কাঁপছিল বিড়ালটি। সে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে বিড়ালটাকে রুমে নিয়ে আসে। গামছা দিয়ে মুছে কাপড়ে পেঁচিয়ে খাটের পূর্বপাশে রাখলে সারা রাত ওর সঙ্গেই ঘুমিয়েছিল।
রহুল উঠে রুমে ঢোকে। বিড়ালটাও ওর পেছনে পেছনে দৌড়ায়। এই বিড়ালটাই এখন ওর বন্ধু। ঘরের আরেক সদস্য। তাই শুধু কাটা নয়, পুরো মাছের অর্ধেকটাও ওর ছোট প্লেটে তুলে দিতে হয়।
লম্বালম্বি শুয়ে পেটে মুখগুঁজে ঘাড় আঁকাবাঁকা করে মাছের অংশটা খেতে খেতে মাঝেমধ্যে ওর দিকে তাকায়। রুহুল ওর নাম দিয়েছে নখু। এই নাম ধরে ডাকলে দৌড়ে ছুটে আসে। কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, হারানো স্মৃতি নেই, কেবল একপেট খাওয়া ছাড়া আর কোনো চাওয়াও নেই। পৃথিবীর সব প্রাণীয় এক, কেবল এই মানুষ ব্যতিক্রম। তাকে খেয়ে অন্যকে ঠকিয়ে হলেও জমা করতে হয়।
কেন জমা করতে হয়?
দ্বৈবস্বরে উত্তর আসে ‘লোভ’ লোভের জন্য...! তাই মাঝেমধ্যে মনে হয় মানুষ হওয়ার চেয়ে ছোট্ট পাখি, দোয়েল কিংবা বাদুড় হওয়াই উত্তম ছিল। তাতে অন্তত অতীত কোনো স্মৃতি থাকত না, কষ্ট থাকত না। ‘ভবিষ্যৎকেও ভাবতে হতো না।
সারারাত আজও ঘুম হলো না। সকাল ৯টার দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও সে আধঘণ্টা আগেই পৌঁছায়। গতরাতেই ম্যাডাম ফোন করে বলেছিল জরুরি কাজে বাইরে যেতে হবে। তার ভাবনায় ঠিক হলো। গাড়িতে উঠেই ম্যাডাম বলল ডিবি অফিসে চলো।
জি আচ্ছা।
টাকাপয়সা এভাবে আগে কখনো দেয়নি, কী বলে যে দেব?
কত দেবেন? জানতে চায় রুহুল।
দশ হাজার।
না ম্যাডাম পঞ্চাশ দেবেন।
কী বলো! এত টাকা!!
হ্যাঁ, খামে ভরে দিয়ে বলবেন চা খেতে দিয়েছেন।
খাম তো আনিনি।
আমার কাছে আছে, ড্রাইভ করতে করতে বাম হাতে হলুদ রঙের খামটা বাড়িয়ে দেয় রুহুল।
এতগুলো টাকা!
সাহেব তো জীবনে কম ইনকাম করেনি, ওখান থেকেই না হয় কিছু দিলেন। তা ছাড়া আপনার কী জানা উচিত নয়, কেন, কীজন্য তাকে খুন করা হয়েছে?
অবশ্যই অবশ্যই, কিন্তু যতটুকু জানি পুলিশ শুধু শুধু টাকা খায়
না ম্যাডাম, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, টাকা খেলে পুলিশ কাজ করে, দেখেন না কত দাগি আসামিও পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ঘোরাফেরা করে, ধরা পড়ে না বুঝলেন তো কেন?
হ্যাঁ, তা তো জানি।
তাহলে? সব টাকার খেলা... তবে টাকাটা আমার সামনে দেবেন না। আমি বাইরে আসার পর দেবেন।
নূরজাহান বেগমকে দেখে ডিবি অফিসার ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হলেন, কালকেই তো বলেছি কেসটা একটু ক্রিটিক্যাল, ক্লো খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন নেটওয়ার্কে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছি।
না মানে... আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে এলাম।
আচ্ছা, বসুন বসুন।
রহুল গাড়ির কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর নূরজাহান বেগম বের হয়ে এলেন।
কি দিয়েছেন?
হ্যাঁ, প্রথমে তো নিতেই চাইল না
এটা ওদের কার্টিসি।
তুমি এতসব বুঝ কীভাবে?
পুর খাওয়া মানুষ ম্যাডাম, তাই মাঝেমধ্যে একটু-আধটু বুঝে যায়।
ঠিক আছে কথা বন্ধ, সাবধানে গাড়ি চালাও।
মৃত্যুর ভয়, তবে ম্যাডামের জীবনে চলে এসেছে। স্বামী খুন হওয়ার পর তিনি বাঁচতেই চাইছিলেন না। সে কি গগনবিদারী চিৎকার। অথচ মানুষের মৃত্যুর শোক এক মাস দুই মাস... বড়জোর... (যে যার মতো বসিয়ে নিয়েন)। নূরজাহান বেগমের নাক ডাকার শব্দে একটু হাসে রহুল।
দিন গড়াতে থাকে কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না পুলিশ। খুনের কোনো মোটিভই খুঁজে পাচ্ছে না। বিগত ছয় মাসের কললিস্ট সার্চ করে দু-চারজন কলগার্লের কথোপকথন ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি, তাদের জিজ্ঞাসা করেও তেমন কিছুই পাওয়া গেল না।
কত নাগর আসে সাহেব, কয়জনেরে মনে রাখব... বুড়া মতো কতজনই তো আসত!
হারুন সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিছুই মিলছে না, আরও দুজন ইন্টেলিজেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
নূরজাহান বেগম এদিকে রুহুলের ওপর চড়াও হয়ে আছে। আমাকে দিয়ে শুধু শুধু এতগুলো টাকা খোয়ালে। আট মাসে একটা ক্লো পর্যন্ত বের করতে পারল না পুলিশ, সেখানে জ্যান্ত একটা খুনিকে ধরবে?
এর মধ্যে কলিং বেলের শব্দ হলো, দেখো তো কে এলো?
দরজা খুলে আমেনা।
এটা কি একরামুল্লাহ সাহেবের বাসা?
জি।
বলো ডিবি অফিস থেকে এসেছি।
খালা, খালা বিছরি রকম চিল্লাইতে চিল্লাইতে আমেনা ডাকল, ডিবি অফিস থেকে আইছে।
ড্রয়িং রুমে বসতে দে।
একটু পর নূরজাহান বেগম এলেন। দুজনের একজনের বয়স প্রায় চল্লিশ, আরেকজনের পঁয়ত্রিশ কী ছত্রিশ, ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছে।
কী ব্যাপার বসুন।
হ্যাঁ, বসুন।
ওনি চাকরি ছাড়া আর কি কোনো ব্যবসা করতেন? সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
তেমন কিছু তো কখনো শুনিনি।
আপনার সঙ্গে কী সব বিষয়ে পরামর্শ, আই মিন শেয়ার করতেন?
না, সবকিছু করতেন না, তিনি একটু কম কথা বলতেন।
ওনার বন্ধুবান্ধব?
না, তেমন কেউ নেই বললেই চলে।
আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, তিনি কেন খুন হতে পারেন?
বিষয়টা জানলে তো আমিই ডিবি অফিসে বলে আসতাম, আপনাদের আর কষ্ট করে আসতে হতো না।
রাগ করবেন না প্লিজ, প্রয়োজনের স্বার্থেই আমাদের জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে।
এসব জিজ্ঞেস তো অনেক আগেও করা হয়েছে, কাজের তো কোনো অগ্রগতি দেখছি না।
দেখবেন, দেখবেন! আচ্ছা এই বাড়িটা কার নামে?
কেন?
না এমনি?
আমার নামে।
আপনার কী আরও কোনো বাড়ি কিংবা জমি আছে?
হ্যাঁ, ওনার আরেকটা বাড়ি আছে, সেটা ওনার নামে।
দুটোই তো কেনা?
হ্যাঁ।
ওই বাড়িটাই কে থাকে?
আমার সাহেবের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়।
কত বছর আগে কেনা?
কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন, আমি ঠিক বুঝতেছি না।
তদন্তের স্বার্থেই আমাদের জানতে হচ্ছে। ওকে আজ তাহলে যাই, আবার দেখা হবে।
আরও এক মাস চলে গেল। দুই অফিসার পরপর আরও দুদিন এসেছেন। কীসব আজগুবি প্রশ্ন করেন।
রুহুল, রুহুল চিৎকার করে ডাকে নূরজাহান বেগম।
জি ম্যাডাম।
আমাকে জেরা করানোর জন্য কি পঞ্চাশ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছি, নাকি খুনিকে ধরতে?
খুনিকে ধরতে।
তবে ওরা দুদিন পরপর এসে আমাকে জেরা করছে, প্রশ্ন করছে... কাজের কাজ তো কিছুই করতে পারছে না এখনো, দারোয়ানকে ডাক আর বলে দাও এসব পুলিশ-টুলিশ যেন আমার বাড়িতে না ঢোকে
ম্যাডাম! তাহলে তো আপনারে মাইন্ড করবে।
উফ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফার ওপর বসেন নূরজাহান বেগম, ভালোই করেছো, টাকা দিয়ে এখন আমাকেই খুনি বানাচ্ছো।
ছি ছি ম্যাডাম।
ম্যাডাম, ম্যাডাম করো না, যাও এখান থেকে।
সারারাত ঘুম হলো না নূরজাহান বেগমের। পুলিশ কি তাহলে তাকেই সন্দেহ করছে। নয়তো এমন জেরা করবে কেন! তাদের সন্তান হয়নি কেন? ডাক্তার দেখিয়েছিলেন কি না? কার সমস্যা ছিল... এসব প্রশ্ন আসছে কেন? আসলে তারা চাচ্ছেটা কী?
কাল আবার ডিবি অফিসে যাওয়ার তারিখ।
রুমে ঢোকামাত্রই হারুন সাহেব বললেন ম্যাডাম দেখছি বেশ শুকিয়ে যাচ্ছেন?
আচ্ছা আপনারে যে আমি টাকাটা দিলাম, খুনিকে ধরতে, না আমাকে জেরা করার জন্য পাঠাতে? সরাসরি প্রশ্ন করলেন নূরজাহান বেগম
রাগ করছেন কেন ম্যাডাম?
খুনিকে না ধরে আমাকে বিরক্ত করছেন কেন?
অনেক সময় সর্ষের ভেতরেও তো ভূত থাকে তা তো জানেন? তদন্তের স্বার্থে আমরা কাউকেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখি না। মরণের যেমন কোনো জাত নেই ম্যাডাম, তেমনি, আমরা পুলিশরাও সন্দেহকে সম্পর্কের ওপর ছাড়ি না। বলতে পারেন আমরা হচ্ছি সন্দেহজাতি! হা হা শব্দের দাঁত বের করা হাসিটা নূরজাহান বেগমের কাছে অসহ্য লাগল।
সত্যিই, পুলিশদের কাছে বিচার চাওয়াই ভুল।
না ম্যাডাম কথাটা সত্যি না, রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পুলিশ আপনাদের পাশে থাকে। আপনাদের স্বামীরা যখন ঈদে নামাজ পড়ে তখন এই পুলিশরাই ডিউটি করে, দেশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাহারা দেয়।
তবে, আমার স্বামীর খুনিদের খুঁজে পাচ্ছেন না কেন?
আশা রাখছি, পাব।
এই রাতেও নূরজাহান বেগমের ঘুম হলো না। তার মাথায় শুধু ঘুরছে ‘সর্ষের ভেতর ভূত’ মানে? কি বোঝাল অফিসার। ওই হাসিরইবা কারু কী? তাহলে কি স্বামী হত্যায় সে নিজেই ফেঁসে যাচ্ছে। তাকেই সন্দেহ করছে সবাই। বেশ তো, দেবর-ভাশুররা জানলে তো কথায় থাকবে না। তেলে ঘি ঢেলে আগুন ছড়াবে। তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারলে সমস্ত সম্পত্তি ভোগ করতে তাদের আর কোনো বাধা থাকবে না।
এভাবে আরও কয়েক দিন চলে গেল। হঠাৎ বৃহস্পতিবার ডিবি অফিসার হারুন সাহেবের মোবাইলে একটি ফোন আসে। খুনিকে ধরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। ভদ্রভাবেই শুদ্ধ ইংরেজিতে বলে কোনপ্রকার চালাকি বা গোয়েন্দাগিরি করবেন না প্লিজ। আমি আবার ফোন দেব।
হ্যালো, হ্যালো
লাইন কেটে যায়। হারুন সাহেব তদন্তের স্বার্থেই পরদিন নূরজাহান বেগমকে ডিবি অফিসে আসতে বলেন। এক ঘণ্টা দেরিতেই নূরজাহান বেগম ডিবি অফিসে পৌঁছায়। সব কথা খুলে বললে নূরজাহান বেগম একবাক্যে স্বীকার করে নেন, হ্যাঁ তিনি পনেরো লাখ টাকা দেবেন। মনে মনে হাফ ছাড়েন তিনি, তাতে তো নিজে অন্তত বাঁচতে পারবেন! কথামতো কাজ এগোতে থাকে। তিন দিন পর আবার অন্য নম্বর থেকে একটি কল আসে। আবার ইংরেজিতে কিছু কথা। যার বাংলা এমন, দেখুন, আমি টাকার লোভে কাজটি করছি না। প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।
অদ্ভুত লাগে ডিবি অফিসারের কাছে।
এই যে টাকা নিচ্ছেন।
না, এ বিষয়টি আপনি জানতে পারবেন।
তবে লেনদেন করব কীভাবে?
হ্যাঁ, আমি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিচ্ছি।
ওকে, শিউর।
তবে অফিসার কোনো চালাকি করবেন না প্লিজ, খুনি ধরা না পড়া পর্যন্ত।
ওকে, আইএম প্রমিজ।
লাইন কেটে গেল। মোবাইল ট্যাক করে দেখা গেল এটি এসেছে যাত্রাবাড়ীর নেটওয়ার্ক থেকে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখা গেল যশোরের ঠিকানা। পুরাতন ড্রাইভার মমিনের বউয়ের।
হ্যাঁ, এটা মমিনের বউ। পরদিন এনসিউর করল নূরজাহান বেগম।
কাহিনি মোড় নিল অন্যদিকে, তাহলে কী মুমিনের বউ...! ডিবি অফিসার নূরজাহান বেগমকে সাবধান করে বললেন, কাউকে না জানাতে। তিনি যশোর থানার মাধ্যমে খোঁজখবর নেবেন।
ডিবি অফিসার হারুন সাহেবের ছক মিলছে না। ওই মহিলা যদি জড়িত থাকে তাহলে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টইবা দেবেন কেন? খুনি কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যায়, এটা কি সেই ভুল? সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে মাথা চুলকান। নাহ্, তা হবে কেন। নিজের সঙ্গে নিজেই হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি।
পরদিন অন্য নম্বর থেকে আবার একটি ফোন। টাকাটা কি জমা দিয়েছেন?
হ্যাঁ, দিয়েছি?
ওকে, আমি চেক করে দেখব, যদি দিয়ে থাকেন তবে ২ ঘণ্টার মধ্যে খুনি আপনাদের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করবে। আর একটি কথা, যার অ্যাকাউন্টে টাকাটা পাঠিয়েছেন তাকেও হাজির রাখবেন। আর হ্যাঁ আবার বলছি, কোনোপ্রকার চালাকি করবেন না। কারণ আপনি দায়িত্ব পালন করছেন, আমিও...
লাইন কেটে গেল। শফিক সাহেব এবার পুরাই দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। খুব দ্রুতভাবেই মমিনের বউকে পুলিশি হেফাজতে ঢাকায় আনা হলো। তাকে এখনো বলা হয়নি যে তার অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ টাকা জমা পড়েছে।
রাতের বেলা নূরজাহান বেগম একপ্রকার উত্তেজিত কণ্ঠে রুহলকে ফোন দিল। রহুল রহুল!
জি ম্যাডাম।
কাল খুব সকালেই চলে আসবে, মিস করতে পারবে না, কেমন?
জি, আচ্ছা।
রুহুল আজ খুব আনন্দিত। পুরো ২টি মাছ ভাজি এবং রান্না করল। নিজে এবং পেট ভরে বেড়ালটাকেও খাওয়াল। খুব ভালো ঘুমও হয়েছে আজ।
সকালে ম্যাডামকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি চালিয়ে ডিবি অফিসের দিকে যাচ্ছে।
এত আনন্দিত ম্যাডাম?
হ্যাঁ, আজকের দিনটির জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম।
সেটি কেমন?
তোমাকে তো বলিনি, আজ খুনি ধরা দেবে।
এটা কোনো কথা হলো, একটা মানুষ খুন করে নিজে এসে ধরা দেবে। এটা কেমন কথা, কখনো শুনেছেন?
তাহলে যে পনেরো লাখ টাকা দিলাম।
তার মানে ওইদিনের ওই যে টাকাগুলো তুললেন।
হ্যাঁ,
চিন্তা কইরেন না, দ্যাখ্যা যাক কী হয়...
জোরে চালাও রুহুল। নূরজাহান বেগম এসি গাড়িতেও ঘেমে যাচ্ছেন।
জি, আচ্ছা।
রুহুল আরও স্পিড বাড়ায়। প্রায় ৭০ কিমি গতিতে চলছে।
আপনাকে ভেতর পর্যন্ত দিয়ে আসি ম্যাডাম?
আচ্ছা চলো।
ভেতরে গিয়ে দেখে মমিনের বউ, ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে মেঝেতে আতঙ্ক চোখে বসে আছে। বড় ছেলের বয়স আর কত হবে এই পাঁচ। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। আর ছোটটি দেড় কী দুই। বেশ কিছু সাংবাদিক ও মিডিয়া চ্যানেল দেখা গেল।
তাহলে থাকেন আমি গাড়ির কাছে যাই, ম্যাডাম।
হ্যাঁ, যাও।
কিছুক্ষণ পর হারুন সাহেবের নম্বরে আবার একটা ফোন আসে, আপনি কী আপনার কথা রেখেছেন?
জি, জি। ভুক্তভোগী দুজন, টিভি সাংবাদিকসহ আপনি যা যা বলেছেন।
থ্যাংকস্, বাট আপনাকে একটু সংশোধন করি ভুক্তভোগী একজন, দুজন না, আমি আসছি।
হারুন সাহেব এবার চিৎকার করে বলল সে আসছে... বি কেয়ার ফুল!
সাংবাদিকরা যার যার জায়গায় অবস্থান নিল। একমাত্র নির্বিকার দেখা গেল মমিনের বউকে।
আরে রহুল এ মুহূর্তে তুমি আসছো কেন? যাও যাও গাড়ির কাছে যাও, বললেন নূরজাহান বেগম।
না, ম্যাডাম আমি আর গাড়ির কাছে যাব না। এই নিন আপনার চাবি।
মানে?
হারুন সাহেব যার আসার কথা ছিল। আমি সেই।
মা-নে? চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠেন নূরজাহান বেগম, সঙ্গে হারুন সাহেবও।
হ্যাঁ, আমার আসার কথা ছিল।
কী বলছো রহুল?
হ্যাঁ ম্যাডাম।
তবে ধরা দিলে কেন? জিজ্ঞেস করল হারুন সাহেব।
ড্রাইভার মমিনের জন্য।
তবে কি তুমিই ওদের ওখানে টাকা পাঠাতে!
হ্যাঁ।
একরামুল্লাহ সাহেবকে খুন করলে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরটা ম্যাডামও চাইলে দিতে পারবেন।
মানে? খুব ক্ষিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে নূরজাহান বেগম।
রসুলবাগের বাড়িটা কী সত্যিই আপনার স্বামী কিনেছিল?
আমি জানি না তোতলাতে থাকেন নূরজাহান বেগম।
আপনি জানেন। ওই বাড়ির মালিক কেন আত্মহত্যা করেছিল, তার একটা ছেলে ছিল, চেনেন তাকে? যাকে বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। বাড়িটা জালসই করে নিয়েছিলেন, কোনো আপত্তি ছিল না। আমার বাবা-মায়ের একটা ছবি পর্যন্ত পেলাম না। সব গায়েব করে দিলেন। আর সবার কাছে বললেন আমার মা আপনাদের কাছে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। সত্যি বিক্রি করেছিল?
এর মধ্যে একজন পুলিশ এসে রুহুলকে হ্যান্ডকাপ পরায়। জবাব দেন না নূরজাহান বেগম। বাতেন মুমিনের বউয়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলে দ্যাখো, তোমার ব্যাংকে পনেরো লাখ টাকা জমা আছে। ওটা তোমার প্রাপ্য, ওটা কাউকে দেবে না। সবগুলো টিভি চ্যানেলে এই একটা কথা একযোগে উচ্চারিত হতে থাকে ওটা তোমার প্রাপ্য... ওটা কাউকে দেবে না...