সংবাদ সম্মেলন শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল দুপুর ১টা। ভিড় হবে জেনেই প্রায় ১ ঘণ্টা সময় হাতে নিয়েই পৌঁছে যাই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। যেখানকার ক্রিস্টাল বল রুমেই প্রথমবার মতো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন হামজা চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লিস্টার সিটির হয়ে এফএ কাপ জিতেছেন, ছিলেন ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলেও। একটা সময় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলাটাই ছিল স্বপ্ন, তবে এখন হামজা বাংলাদেশের।
হোটেলের লবিতে গমগমে ভিড় পেরিয়ে সংবাদ সম্মেলনের নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছানোর পথে চোখে পড়ে অনেক পরিচিত মুখ। ক্রিকেট সাংবাদিকতার সূত্রে তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই দেখা হয় মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে, ফুটবলের কোনো আয়োজনে তাদের উপস্থিতির নিমিত্ত হামজা চৌধুরী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভরে উঠল মাঝারি আকৃতির মিলনায়তন। প্রথাগত গণমাধ্যমের বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ‘কন্টেন্ট ক্রিয়েটর’দেরও অবাধ বিচরণ। তাদের মোবাইল প্রায়শই ‘ফ্রেম’ খারাপ করে দিচ্ছে আলোকচিত্রীদের, এই নিয়ে সিনিয়র আলোকচিত্রীদের অসন্তোষও চাপা রইল না। একই সংবাদ সম্মেলনে পৃষ্ঠপোষকদেরও নিয়ে এসে সামনের সারিতে বসানোর ব্যবস্থাও মনঃপূত হয়নি অনেকের। এসব নিয়ে চাপান উতোর চলতে চলতেই একসময় মঞ্চের ডান পাশের দরজা দিয়ে হাজির হলেন হামজা, কোচ হাভিয়ের কাবরেরা, অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া আর সঙ্গে পৃষ্ঠপোষক ইউসিবি’র প্রধান নির্বাহী মামদুদুর রশিদ।
সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকটির সঙ্গে প্রথমেই বিশ্বাসঘাতকতা করল টেবিলের মাইক্রোফোন। বক্তার সামনে রাখা মাইক্রোফোনটি অকার্যকর। সেটা ঠিক করতে কোচ কাবরেরার কথা বলার মধ্যেই মঞ্চে উঠে গেলেন একজন কর্মী, তাতে করে আলোকচিত্রীদের উষ্মাধ্বনি। প্রশ্নকর্তারা অধৈর্য, সঞ্চালক অপটু। ফল সম্মেলন কেন্দ্রের নানান প্রান্ত থেকে একই সঙ্গে একাধিক প্রশ্নের উৎপত্তি, যে জোরে বলতে পেরেছেন তার প্রশ্নেরই উত্তর মিলেছে। মঞ্চে বসে এসব দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন হামজা। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে প্রথম পাঠটা বুঝি হয়ে গেল সেখানেই। ব্রিটিশ সভ্যতা এখানে আশা করে লাভ নেই, এই চরম সত্যটা হামজা বুঝে গেলেন গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রথম মিথস্ক্রিয়াতেই।
শুরুতেই কাবরেরার কাছে যে বাক্যবাণটা গেল তার মূলভাব হচ্ছে, হামজা এসেছেন এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিততেই হবে। কোচ কাবরেরা ধীরেসুস্থে উত্তরে বললেন যে ফুটবলে যে কোনো কিছুই হতে পারে, তবে হামজা যোগ দেওয়াতে বাংলাদেশের শক্তি বেড়েছে। কাবরেরাকেও বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো হামজাকে কেন্দ্র করেই। হামজা একাদশে আসলে কার জায়গায় খেলবেন, হামজাকে নিয়ে পরিকল্পনা কি এসবের উত্তর দিতেই ব্যস্ত স্প্যানিশ কোচ। উঠে এলো ফাহমিদুল ইসলাম ও কথিত সিন্ডিকেট প্রসঙ্গও। দেশের ফুটবলে নাকি অদৃশ্য সিন্ডিকেট আছে, তাদের ইচ্ছাতেই বাদ পড়েছেন ইতালি প্রবাসী ফুটবলার ফাহমিদুল, এমন অভিযোগ তুলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশের একদল ফুটবল সমর্থক। ইতালির চতুর্থ বিভাগে খেলা এই ফুটবলারকে দেখতে ট্রায়ালে ডেকেছিলেন কোচ কাবরেরা, সৌদি আরব থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। গা গরমের ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা ফাহমিদুল কেন দলে নেই সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোচ, ‘সে প্রতিভাবান ফুটবলার। আমি তাকে দলে নেওয়ার আগেও অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি আবারও বলছি, তার আরও সময় প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সে জাতীয় দলে খেলার যোগ্য’ বলেছেন কাবরেরা। ফুটবলে দল বাছাই, কৌশল নির্ধারণে কোচই সর্বেসর্বা। সেখানে একজন ১৮ বছর বয়সী আধা-পেশাদার ফুটবলার, যার আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই সে রকম একজনকে দলে নিতে জাতীয় দলের কোচের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা যায়, এ রকম অভূতপূর্ব দৃশ্যও বোধহয় প্রথম দেখলেন হামজা।
এরপর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পালা জামাল ভূঁইয়ার। ১২ বছর আগে, ২০১৩ সালে লোডউইক ডি ক্রুইফের সময় ডেনমার্ক প্রবাসী জামালের সন্ধান পেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রবাসে জন্মানো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের জাতীয় দলে খেলার শুরুটা তাকে দিয়েই। জামালের মনে হয়েছে, হামজাও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত শুনে আবেগাপ্লুত হবেন, ‘হ্যাঁ অবশ্যই, আমি যখন এসেছিলাম, তখন পরিস্থিতিটা কিছুটা এমনই ছিল। হামজা যখন জাতীয় সংগীত শুনবে, তার গায়ে কাঁটা দেওয়া শুরু করবে। আমারও একই রকম হয়েছিল। হয়তো শুরুতে ওর একটু নার্ভাস লাগবে, তবে ম্যাচ শুরু হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে’। ভারত সুনীল ছেত্রীকে অবসর ভেঙে ফিরিয়েছে বাংলাদেশ ম্যাচের জন্য। এই ফরোয়ার্ড বারবার হৃদয় ভেঙেছেন বাংলাদেশের, তবে এবার আর পারবেন না বলেই মনে করেন জামাল, ‘সে (সুনীল) ভালো খেলোয়াড়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলোয়াড় তো নয়। আমাদের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড় (হামজা) আছে।’ শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে এখন অবশ্য হামজা খেলছেন চ্যাম্পিয়নশিপে, প্রিমিয়ার লিগের ঠিক নিচের ধাপে। তারপরও জামালের চোখে হামজাই বাংলাদেশের জন্য মেসি!
অবশেষে সুযোগ এল হামজা চৌধুরীকে প্রশ্ন করার। মৃদুভাষী, স্মিত হাস্যের হামজা প্রথম প্রশ্নের উত্তর শুরু করেছেন সালাম জানিয়ে। লিস্টার সিটির এফএ কাপ জয়ের আন্ডারডগ স্টোরির অংশ হওয়ার মতো বাংলাদেশের হয়েও তেমন কোনো গল্পের অংশ হতে চান কি না, ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পেলে বাংলাদেশের হয়ে খেলার কথা ভাবতেন কি না, বাংলাদেশের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ইংল্যান্ডে তার সতীর্থরা কী বলেছেন এমন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন হামজা। বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিল ইংরেজিতে। একজন প্রশ্ন করেছেন সিলেটি বাংলায়, উত্তরটাও শুনতে চেয়েছেন সিলেটিতে। হামজা জানালেন, ‘সবে খুব বালা বালা মাতসে, আমারে দেখতে আজার আজার মানুষ আইসে’ (সবাই খুব ভালো ভালো কথা বলেছে, আমাকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ এসেছে)। এভাবেই নিজের শেকড়কে মনে করলেন হামজা, যে শেকড়ের টানেই বিলাত ছেড়ে বাংলাদেশে তার আগমন।
সংবাদ সম্মেলনের পর স্কুলের বাচ্চাদের একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের জার্সি উন্মোচনের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানেও মঞ্চে আসতে হলো হামজাকে, তার সঙ্গে বাচ্চারা, পৃষ্ঠপোষক, অভিভাবক অনেকেই ছবি তুললেন। এখানেই শেষ হয়নি হামজার কর্মব্যস্ত দিন। কিছুক্ষণ পরই তাকে যেতে হলো ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার বাসভবনে। সেখান থেকে এসে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের মাটিতে দলের সঙ্গে একমাত্র অনুশীলনে। শেফিল্ডের হয়ে ম্যাচ খেলেই বাংলাদেশে এসে হবিগঞ্জে গেছেন, সেখান থেকে ঢাকায় এসে পরদিন সংবাদ সম্মেলন। সন্ধ্যায় বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় অনুশীলন। অফুরন্ত প্রাণশক্তি না থাকলে এই ধকল সামলানো সম্ভব নয়। প্রিমিয়ার লিগে খেলতে গেলে কতটা উঁচু শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যরে প্রয়োজন হয়, সেটা অন্তত গত দিন দুয়েকে হামজার কর্মসূচি দেখেই বোঝা গেল!
হামজা বলেছেন, সামনে অনেক সময় আছে। বাংলাদেশের হয়ে অনেকদিন খেলাই তার ইচ্ছা। তবে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট থেকে একবারে সবগুলো ডিম বের করে ফেলার লোভ যদি পেয়ে বসে বাফুফেকে, আর অব্যবস্থাপনার মাত্রা যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে হয়তো একটা সময় মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন হামজা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নিচের সারির লিগের খেলোয়াড়রা এসে মানিয়ে নিতে না পেরে চলে গেছেন অতীতে। কোচদের বিদায়েও ইতিহাসও ভালো নয়। আছে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণও। হামজার মতো ফুটবলার এসে যদি মানিয়ে নিতে না পারেন, তাহলে সবকিছুর সঙ্গে এই দায়টা নিতে হবে বাফুফেকেই।