বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পুতিনের কৌশলগত জয়

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৫, ১২:২৫ এএম

তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার অভিযান শুরুর পর থেকে এখনো কোনো যুদ্ধবিরতি দেখা যায়নি অঞ্চলটিতে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একে অন্যের বিদ্যুৎ-জ¦ালানি অবকাঠামো, রেল ও বন্দরসংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোয় ৩০ দিনের জন্য হামলা বন্ধে সম্মত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রাথমিক সময়সীমায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিয়েভ তাতে রাজি হলেও, খুব সুকৌশলে তা এড়িয়ে গেছে মস্কো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে সর্বশেষ যে ফোনালাপ হয়েছে তাতে ভøাদিমির পুতিন সামান্য ছাড় দেওয়ার বিনিময়ে কৌশলগত বড় জয় অর্জনের পথ পরিষ্কার করলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ফোনালাপের মাধ্যমে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে এবং বিশ্বমঞ্চে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তনের পথ খুলতে অনেকাংশেই সফল হয়েছেন। তেমনি ইউরোপ ও ন্যাটোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের বিভেদ বাড়িয়ে দেওয়ার পথেও অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন।

মঙ্গলবার দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে দীর্ঘ ফোনালাপের আগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা রাশিয়াকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে চায়। যে প্রস্তাবে আগেই ইউক্রেন সম্মত হয়েছিল এবং যাকে পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তির দিকে প্রথম পদক্ষেপ মনে করা হচ্ছিল। তবে ভøাদিমির পুতিন সে প্রস্তাব প্রত্যাখান তো করেছেনই, উল্টো এই দরকষাকষির খেলায় রাশিয়াকে সুবিধাজনক স্থানেও নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগ যেন ব্যর্থ বলে প্রতিভাত না হয়, সে বিষয়টি খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে সামলেছেন তিনি। ট্রাম্প যে খালি হাতে ফিরছেন, এমনটা যেন ধরা না পড়ে তা নিশ্চিতে পুতিন সামান্য ছাড়ের এই সতর্ক চাল চেলেছেন বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষকই। কেননা এই সাময়িক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৃতিত্ব জাহিরে চাউর হয়েছে তার প্রশাসন। ফক্স নিউজের হেনিটি অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, কিছুকাল আগ পর্যন্তও আমরা জ¦ালানি ও অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতির এবং কৃষ্ণসাগরে গোলাগুলিতে স্থগিতাদেশ এ দুটো বিষয় নিয়েও একমত হতে পারিনি। আজ আমরা এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি। আমার মনে হয় এখান থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির দূরত্ব তুলনামূলক অনেক কম বলে মন্তব্য করেন তিনি। হোয়াইট হাউজ বলছে, শুধু জ¦ালানি অবকাঠামোই নয়, দুই দেশের মধ্যে কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির আলোচনাও শিগগিরই শুরু হচ্ছে। ওয়াশিংটন এগুলোকে অর্জন হিসেবে দেখাতে চাইলেও ইউরোপের অনেক বিশ্লেষক তা মনে করছেন না। তাদের মতে, জ¦ালানি অবকাঠামো ও সমুদ্রপথে হামলা বন্ধ হলে তা ইউক্রেনের জন্য ভালো হবে না। কেননা যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত তারা রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র তেল স্থাপনাগুলোতে এবং বড় রুশ নৌবাহিনীর ওপর কিয়েভ যেসব হামলা চালিয়েছে তা মস্কোর অগ্রগতি অনেকাংশেই কমিয়েছে।

লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ নাইজেল গুল্ড-ডেভিস বলেছেন, পুতিন বৃহত্তর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প যদি আরও নিষেধাজ্ঞাসহ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ জোরদার না করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট হয়তো যুদ্ধবিরতির বিষয়টিকে খুব একটা আমলেই নেবেন না। তিনি আরও বলেন, পুতিন যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী, কিন্তু এর সঙ্গে স্পষ্টতই অগ্রহণযোগ্য কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন, যা আসলে এক প্রকারের না। কিন্তু এখন জ¦ালানি অবকাঠামো আর সমুদ্রপথে হামলায় বিরতি এলে রাশিয়া তার পুরো মনোযোগ স্থল অভিযানে দিতে পারবে। বিশেষ করে তাদের পশ্চিমাঞ্চলীয় কুরস্কে। গত আগস্টে আচমকা এক আক্রমণে ওই এলাকার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল ইউক্রেনীয় সেনারা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রুশ সেনারা ওই এলাকার সিংহভাগই দখলমুক্ত করেছে। পশ্চিমাপন্থি রুশ রাজনীতিক আন্দ্রেই কোজিরেভ মনে করছেন, ফোনালাপ থেকে ট্রাম্পের অর্জন একেবারেই শূন্য। ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই রাজনীতিক বলছেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো সবই হচ্ছে পুতিনের স্বার্থে। ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ এক রুশ সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, পুতিন ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছেন। তাতে ইউক্রেনীয়রা পিছু হটবে আর ধীরে ধীরে তারা ভূখণ্ড এবং জনগণ সবই হারাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সীমিত আকারে শুধু জ¦ালানি অবকাঠামোতে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকে, তাহলে একে কোনোভাবেই পুতিনের দিক থেকে বড় ছাড় মনে করা যাবে না। ইউক্রেনের জ¦ালানি গ্রিডে হামলা বন্ধের বিনিময়ে তিনিও রাশিয়ায় বড় তেল স্থাপনাগুলোতে ড্রোন হামলা থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ৩৩ লাখ টন তেলের মজুদ কিয়েভের হামলায় ধ্বংস হয়েছে বলে অনুমান রয়টার্সের, যা রাশিয়ার মোট পরিশোধন সক্ষমতার ৪ শতাংশের সমপরিমাণ নষ্ট করে দিয়েছে। কোজিরেভের মতে, জ¦ালানি স্থাপনায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে পুতিন আদতে বিন্দুমাত্রও ছাড় না দিয়ে হামলা বন্ধ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াও পূরণ করেছেন। তবে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের মধ্যে এবারই প্রথম মস্কো-কিয়েভ দুপক্ষ তাদের বৈরিতা অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য হলেও কিছুটা কমাতে রাজি হয়েছে। এটাকে স্বস্তিদায়ক মানছেন সবাই। দুই প্রেসিডেন্টের ফোনালাপের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি জ¦ালানি স্থাপনায় হামলা বন্ধ রাখতে রাজি। ফোনালাপের পর ক্রেমলিন তার বার্তায় জানিয়েছিল, যুদ্ধ বন্ধে উভয় প্রেসিডেন্ট দ্বিপক্ষীয় কাঠামোর মধ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। এই ঘোষণার ফলে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের শঙ্কাও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের ভয়, ট্রাম্প ইউক্রেন ও ইউরোপকে বাইরে রেখেই পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলতে পারেন, যা ভবিষ্যতের জন্য তাদের আরও বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করতে যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছিল, সে চিত্র বদলাতে চাচ্ছেন পুতিন। তার বিপরীতে পুতিন চাইছেন রাশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার স্থানে ফিরিয়ে আনতে। আর রুশ প্রেসিডেন্ট যে তার লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া। তিনি বলেন, এটি অবশ্যই পুতিনের জন্য বিরাট সাফল্য। যিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ইউক্রেন সংঘাতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে রাশিয়ায় ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনার টোপও দিচ্ছেন। আরেক বিশেষজ্ঞ গুল্ড-ডেভিস বলেছেন, ওয়াশিংটনকে তার ন্যাটো মিত্রদের থেকে আলাদা করার চেষ্টায় পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় নানা চুক্তি সই করতে চাচ্ছেন। এখন ইউরোপকে খুব দ্রুত নিজের প্রতিরক্ষার জন্য সম্পদ জোগাড় করতে হচ্ছে। চলমান এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সীমিত পর্যায়ে থাকবে, তেমনটা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ কম।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত