বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে অর্জিত আয়। সত্যিকার অর্থে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। এরপরই রয়েছে গার্মেন্টস। বিদেশে বেশিরভাগ মানুষ শ্রমিক, অর্থাৎ শতকরা ৯৫ ভাগ শ্রমজীবী, বাকি ৫ ভাগ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যবসায়ী। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে ছিল। গত বছর শেষে বাংলাদেশে সাড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বর্তমানে ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রবাসী আয় প্রবাহে জোয়ার বইছে। চলতি মার্চ মাসের প্রথম ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৮.৪ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে মার্চ মাসে রেমিট্যান্স ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা হবে নতুন মাসিক রেকর্ড। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মজবুত হয়েছে অর্থনীতির ভিত। এ বিষয়ে শুক্রবার দেশ রূপান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মরত রয়েছেন বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যে ১০ দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য। এই ১০ দেশ থেকে আসছে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ। আসলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই বেড়ে যায় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি। চলতি মাসের ১৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন বা ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার। সে হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ১২ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসছে। আগে এত বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ দেখা যায়নি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের পুরো সময়ে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে রেমিট্যান্স।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি প্রধান উৎস হলো রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি। কয়েক দশক ধরে রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জীবনশক্তি হিসেবে কাজ করছে। কমবেশি সবার জানা, পর্যাপ্ত রিজার্ভ ছাড়া জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করা যায় না। এমনকি বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় রিজার্ভ থেকে। যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, তখন রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি রিজার্ভ বাড়িয়েছে। এছাড়া রপ্তানি আয় বাড়াতে তৈরি পোশাকের মতো পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য, হস্তশিল্পসহ অন্যান্য পণ্যে গুরুত্ব দিতে হবে।
রেমিট্যান্স আয় দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে বেকারত্ব হ্রাসের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং একইসঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। তাই এ খাতে নীতি সহায়তাসহ মাঠ পর্যায়ে বিশ্ববাজারের জন্য উপযোগী দক্ষ শ্রমিক তৈরির প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিশ্বের ১৭৪ দেশে জনশক্তি রপ্তানি হলেও ২৬ দেশে বাংলাদেশ মিশনে শ্রমকল্যাণ উইং আছে। এসব উইংয়ে জনবলেরও সংকট রয়েছে। প্রবাসীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও অধিকার আদায় করে উইং। আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় ৩৫ লাখের বেশি প্রবাসী আছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার প্রবাসী ১০ কোটি টাকা করে দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রবাসীদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও নিরাপত্তার বিষয়টি মিশনগুলো বিবেচনা করতে পারে।
প্রবাসীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করতে হবে। প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি এবং হুন্ডি ব্যবসা প্রতিরোধ করা গেলে রেমিট্যান্সই বদলে দেবে বাংলাদেশ। শুধু রেমিট্যান্স এবং একটি পণ্যে নির্ভরতা, দীর্ঘমেয়াদে রিজার্ভকে স্থিতিশীল করবে না। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, রিজার্ভ বাড়াতে নতুন খাত সৃষ্টি করতে হবে। খুঁজতে হবে নতুন শ্রমবাজার। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে, অভিবাসীদের সমস্যাগুলো সামনে রেখে সমাধান জরুরি। রেমিট্যান্সের হাওয়া কীভাবে দীর্ঘায়িত এবং এর গতিবেগ আরও বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্তর্র্বর্তী সরকার প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এটিই প্রত্যাশা। রেমিট্যান্স স্রোতে ভাসুক বাংলাদেশ।