বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ইয়াসরিবের যুবকদের ঐতিহাসিক বাইয়াত

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৫ এএম

খেজুরবৃক্ষের বাগান ও পাহাড়-টিলা বেষ্টিত একটি শহর, মক্কা নগরী থেকে প্রায় ৪৩৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, পরবর্তী সময়ে শহরটি মদিনা নামে পরিচিতি লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করিম (সা.) মেরাজের রাতে জিবরাইল (আ.)-এর আহ্বানে এখানে এসে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। ঐতিহাসিকভাবে এই নগরীর পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব।

ইয়াসরিবে দুটি আরব গোত্র বসবাস করত। আউস ও খাজরাজ। তাদের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ লেগে থাকত। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইহুদিরা তাদের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টি করত এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিল করত। তবে ইয়াসরিবের অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই জানত যে, এখানে সর্বশেষ নবী আসবেন, যিনি কুরাইশ বংশের হবেন। তাই নবী করিম (সা.)-এর আগমন তাদের কাছে খুবই প্রত্যাশিত ছিল।

মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় একাগ্রতার সঙ্গে নিজের জীবন ও ধনসম্পদ জান্নাতপ্রাপ্তির বিনিময়ে মহান আল্লাহর কাছে সমর্পণ করাকে বাইয়াত বলা হয়। মহানবী (সা.)-এর জীবনে এমন তিনটি বড় ঘটনা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি সাহাবিদের বিশেষ দলকে বিশেষ উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছিলেন। এখানে নবী-জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ তিন বাইয়াতের বিবরণী তুলে ধরা হলো।

প্রথম বাইয়াত : নবুয়তের একাদশতম বছরে হজ মৌসুমে ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের ছয়জন যুবক মক্কায় আগমন করেন। নবী করিম (সা.) তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং কোরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। সত্যের এই আহ্বান শুনে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইয়াসরিবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে প্রথম আকাবার বাইয়াত বলা হয়। এই বাইয়াতে অংশগ্রহণকারী যুবকরা হলেন আসআদ ইবনে যুরারা, আউফ ইবনে হারেস, রাফে ইবনে মালেক, কুতাবা ইবনে আমের, উকবা ইবনে আমের ও আবুল হাইছাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

দ্বিতীয় বাইয়াত : প্রথম বাইয়াত গ্রহণকারী ছয়জন যুবক ইয়াসরিবে ফিরে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাদের প্রচেষ্টায় ইসলামের বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক বছর পর নবুয়তের দ্বাদশ বছরে ইয়াসরিব থেকে ১২ জন ব্যক্তি হজ উপলক্ষে মক্কায় আসেন এবং আকাবা উপত্যকায় নবী করিম (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াতে তারা শপথ করেন এক. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং শিরক করবেন না। দুই. ব্যভিচার করবেন না। তিন. চুরি করবেন না। চার. সন্তান হত্যা করবেন না। পাঁচ. মিথ্যা অপবাদ দেবেন না। ছয়. ন্যায্য বিষয়ে নবীজির আনুগত্য করবেন। দ্বিতীয় বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেন ১২ জন যুবক। এর মধ্যে প্রথম বাইয়াতের ৫ জনও ছিলেন। বাইয়াতে নতুন সাতজন অংশগ্রহণকারী হলেন মুআজ ইবনে হারেস, যাকওয়ান ইবনে আবদে কায়স, উবাদা ইবনে সামেত, ইয়াযিদ ইবনে ছালাবা, আব্বাস ইবনে উবাদা, উয়াইম ইবনে সায়েদা ও আবুল হাইছাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

যখন তারা বাইয়াত সম্পন্ন করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করতে চাইলেন, তখন মহানবী (সা.) তাদের কোরআন শিক্ষা ও ইসলাম সম্পর্কে অধিক দীক্ষার জন্য তার প্রিয় সাহাবি মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-কে তাদের সঙ্গে ইয়াসরিব নগরীতে প্রেরণ করলেন। তিনি ইয়াসরিব নগরীতে পৌঁছে সেখানকার ঘরে ঘরে ইসলামের অমিয় বাণী ও পবিত্র কোরআনের সুধা পৌঁছাতে লাগলেন। এভাবেই সবার চোখের আড়ালে পর্যায়ক্রমে ইয়াসরিব নগরীর ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআনের আলো পৌঁছতে লাগল। আর এতে মক্কার অদূরে ইয়াসরিব নগরীতে ইসলামের সৈনিক তৈরি হতে থাকে। পাশাপাশি মহানবী (সা.) এবং তার সাহাবিদের হিজরতের দ্বার উন্মোচন হতে থাকে।

তৃতীয় বাইয়াত : দ্বিতীয় বাইয়াতের পর ইয়াসরিবে ইসলামের প্রচার আরও জোরদার হয়। নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারীসহ মোট ৭৫ জন মক্কায় এসে নবী করিম (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে আসে, কারণ এখান থেকেই নবী করিম (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পথ উন্মুক্ত হয়। তৃতীয় বাইয়াতের আবেদন করে ইয়াসরিববাসীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার পবিত্র হাত প্রসারিত করুন, আমরা আপনার বাইয়াত গ্রহণ করব। রাসুল (সা.) তার হাত বাড়িয়ে দিলেন, আর তাদের সর্দার আসআদ ইবনে জারারা (রা.) বাইয়াত গ্রহণ করে ধন্য হন। তারপর একে একে সবাই বাইয়াত গ্রহণ করেন। এই বাইয়াতে ইয়াসরিবের মুসলিমরা নবী করিম (সা.)-কে প্রতিশ্রুতি দেন এক. তাকে রক্ষা করবেন, যেভাবে নিজেদের পরিবার ও সম্পদ রক্ষা করেন। দুই. ইসলামের পথে লড়াই করবেন। তিন. সুখে-দুঃখে তার প্রতি অনুগত থাকবেন।

এই তিনটি বাইয়াতের মাধ্যমে ইয়াসরিবে ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং এটি নবী করিম (সা.)-এর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। এরপরই তিনি সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের অনুমতি দেন এবং কিছুদিন পর নিজেও হিজরত করেন। এই হিজরতের মাধ্যমেই মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়।

ইয়াসরিবের যুবকদের এই বাইয়াত ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মদিনা ইসলামের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এই বাইয়াতের মাধ্যমেই নবী করিম (সা.)-এর নেতৃত্বে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত