সকাল ১০টার আগে ভূমি অফিসে হাজির স্বপন রায় নামে এক ব্যক্তি। একই সময়ে হাজির অফিসের তহশিলদার ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতোই সরকারি কম্পিউটার কাপড় দিয়ে মুছে তা নিয়ে বসে পড়লেন স্বপন। সঙ্গে সঙ্গে হাজির সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষ। কর্মকর্তাদের মতো একে একে সেবা প্রদান শুরু করেন তিনি। তবে স্বপন রায় ভূমি অফিসের সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা নন। অথচ জমি সংক্রান্ত সব কাজ তিনিই করে যাচ্ছেন। আর বিনিময়ে নিচ্ছেন সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ২০-৩০ গুণ টাকা। এমন চিত্রের দেখা মেলে দিনাজপুর সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। এ চিত্র নতুন নয়। প্রায় আড়াই বছর ধরে এটি দেখছেন এই ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষেরা।
ভূমি অফিসে দালালের মাধ্যমে কাজ হয় এমন ঘটনা নতুন নয়। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কার্যালয়ে বসেই সরকারি কম্পিউটার ব্যবহার করে সেবা দেওয়ার নামে সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে সরকারি ফি’র চেয়ে ২০-৩০ গুণ টাকা আদায় বিরল ঘটনা। টাকা না দিলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষদের। তাই তো ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে সেবা গ্রহণ করতে হয় ভুক্তভোগীদের। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে ভূমি অফিসে গেলে স্বপনের বিরুদ্ধে সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ২০-৩০ গুণ টাকা আদায়ের অভিযোগ করেন সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষেরা।
সেবা নিতে আসা ৮০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি ২৬ শতক জায়গা খারিজ করার জন্য আবেদন দিই। পরে স্বপন আমার থেকে খারিজ করার জন্য ২৮ হাজার টাকা নেয়। কিন্তু ১০০ শতক পর্যন্ত জমি খারিজ করার সরকারি ফি ১১৭০ টাকা। তহশিলদারকে কিছু বলতে গেলে তিনি সরাসরি স্বপনকে দেখিয়ে দেন।’
শামসুল হক নামে এক ভূমির মালিক বলেন, ‘স্বপনকে টাকা না দিলে কোনো কাজ হয় না। তহশিলদার কোনো সেবা প্রদান করেন না। ইতিপূর্বে কয়েকজন তহশিলদার এই অফিসে চাকরি করেছেন। তারা সবাই স্বপনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতি করেছেন।’
আল আমিন নামে এক কৃষক বলেন, ‘টাকা নেওয়ার একটা লিমিট থাকে। এই অফিসে টাকা নেওয়ার কোনো লিমিট নেই। স্বপনের মাধ্যমে তহশিলদার টাকা নেন। টাকা না দিলে কাগজে ঝামেলা আছে বলে আটকে রাখেন। অথচ টাকা দিলে সেই কাগজে কোনো ঝামেলা থাকে না।’
শশরা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর আনাফ বলেন, ‘মানুষের থেকে নির্দিষ্টর ফি থেকে অধিক আদায় করা অন্যায়। যদি তহশিল অফিসের ব্যক্তিরা বেশি ফি নেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। উনি কে, কে তাকে নিয়োগ করল ভাবা উচিত। সরকারি চাকরিজীবী না হয়েও যদি এটা করে তাহলে কারণটা কী? এটা আইনগতভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।’
টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন স্বপন। এ ব্যাপারে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এক পর্যায়ে সংবাদটি না করার জন্য দেওয়া হয় অর্থের প্রস্তাব। প্রতিনিধির পকেটে পুরে দেন মিষ্টি খাওয়ার টাকাও।
স্বপন রায় বলেন, ‘আমি প্রায় ২ বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক এখানে আছি। তাদের বেতন থেকে আমাকে টাকা দেয়। আর সাধারণ মানুষ স্ব-ইচ্ছায় টাকা দিলে নিই। তাছাড়া নিই না।’ চুক্তিপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো চুক্তিপত্র নেই, মৌখিক চুক্তি।’
শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার চাকরি শেষের দিকে। বয়সের কারণে আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না। সে জন্য স্বপন নামের ছেলেকে কম্পিউটারে কাজের জন্য নিজে রেখেছি। তার স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী কোনো নিয়োগ নেই।’
অতিরিক্ত টাকা গ্রহণের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখানে বেশি টাকা নিতে পারে না। এটা আমার জানা নেই।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান বলেন, ‘আমাদের সাধারণ মানুষ যারা আছেন তাদের অনুরোধ করতে চাই যে, আপনারা যে কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কেউ যদি কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বা কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে সুবিধা আদায় করতে চায় তাহলে আপনারা সরাসরি আমাদের জানাবেন। অন্তত শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করব।’