রমজানের প্রথম ভাগে আল্লাহতায়ালা বান্দাদের প্রতি দয়াবর্ষণ করেন, দ্বিতীয় ভাগে ক্ষমা করেন এবং তৃতীয় ভাগে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হলো, আল্লাহ যদি করুণা করতে চান, ক্ষমা করতে চান, মুক্তি দিতে চান; তা যতসংখ্যক মানুষের জন্যই হোক না কেন এবং যে পরিমাণেই হোক না কেন; তা তো এক মুহূর্তেই করতে পারেন, এতে ১০ দিন সময় লাগবে কেন?
ইসলামি স্কলারদের মতে, আসলে রমজানের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বাহ্য অর্থ ছাড়াও এর রয়েছে তাত্ত্বিক এক নিগূঢ় রহস্য। তা হলো, রমজান তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। আল্লাহ চান বান্দা তার গুণাবলি অর্জন করে ওই গুণে গুণান্বিত হোক। যেহেতু মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি, তাই তাকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে হলে অবশ্যই ওই গুণাবলি অর্জন করতে হবে। গুণাবলি অর্জনে রমজানের শেষ দিনগুলোয় বান্দার করণীয় হলো দুনিয়ার সবকিছুর আকর্ষণ ও মোহ থেকে মুক্ত হয়ে প্রভুপ্রেমে বিভোর হওয়া। বিশেষ করে সব ধরনের অন্যায় অপরাধ-অপরাধ, যা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ, সেগুলো থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখা এবং সেসবের আকর্ষণ থেকে পরিপূর্ণরূপে মোহমুক্ত হওয়া। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাপমুক্তির আশায় ব্যাকুল হয়ে এ সময় ইবাদতে নিজেকে সঁপে দেওয়ায়, ইতিকাফে বসায়। এর মাধ্যমে বান্দা শবেকদর লাভে ধন্য হয়।
রমজান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে লাইলাতুল কদর বা শবেকদর। কোরআন-হাদিসে এ রাতের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এ রাতের অন্বেষণে যেমন আগ্রহী হওয়া দরকার, তেমনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, তওবা-ইসতেগফার, দোয়া-দরুদ ইত্যাদির প্রতি যতœবান হওয়া জরুরি। এ রাতে আল্লাহর অবারিত রহমত ও করুণা বর্ষিত হয়।
লাইলাতুল কদরের বিষয়ে স্পষ্ট সুসংবাদ রয়েছে। এরপরও এ রাতের প্রতি আগ্রহী না হওয়া অনেক বড় বঞ্চনার বিষয়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রমজান এলে নবীজি (সা.) বলতেন, যে মাসে তোমরা উপনীত হয়েছো, তাতে একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকল, সে যেন সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৬৪৪)
তাই কোনো ধরনের হেলায় না কাটিয়ে কদরের রাতের অন্বেষণ করা কাম্য। প্রশ্ন হলো, এ রাত কত তারিখে? হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী কদরের রাতের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। তবে রমজানের শেষ ভাগে (শেষ ১০ দিনে) তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে ইবাদতের মাত্রা ও পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) নবীজির শেষ ১০ দিনের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে অন্যদিনের তুলনায় (ইবাদত-বন্দেগিতে) আরও বেশি মেহনত করতেন।’ (সহিহ মুসলিম ১১৭৫)
হাদিসে যেহেতু কদরের রাত নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো সামনে রেখে যা বুঝে আসে, লাইলাতুল কদর লাভের জন্য পুরো রমজান বিশেষ করে শেষ ১০ দিন, আরও বিশেষ করে বললে শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোয় তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই একজন মুমিনের এর অন্বেষণে পূর্ণ সজাগ এবং প্রস্তুত থাকা চাই। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (সহিহ বোখারি ২০২০) আরেক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোয় কদর রাত অন্বেষণ করো।’ (সহিহ বোখারি ২০১৬)
লেখক : ইমাম ও খতিব, দারোগা আমীর উদ্দিন ঘাট মসজিদ, বাবুবাজার, ঢাকা