প্রচলিত আইন, সরকারের সিদ্ধান্ত, সর্বোপরি উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ তাদের সম্পদের সঠিক হিসাব বিবরণী দেন না। অথচ চাকরিতে ঢোকার সময় সম্পদের হিসাব দেওয়া এবং প্রতিবছর তা হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই অনেকে সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশ্যে আনতে চান না। অর্জিত সম্পদ রাখতে চান আড়ালে-আবডালে। এমনটি কেন করা হয়, কমবেশি সবাই বোঝেন। এই তারাই বছরের পর বছর ধরে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। এই কর্মচারীরাই দুর্নীতিতে বিশ্বে নাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন সরকার এ বিষয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। তারা দায়সারাভাবে বলেছে- সম্পদ বিবরণী অমুক তারিখের মধ্যে দিতে হবে। এরপর বলা হয়েছে, এবার সময় বাড়ানো হলো। তারপরও বিবরণী জমা দেওয়া হয়নি। সরকারও চাপ দেয়নি। বর্তমানে এই দুর্নীতিচক্র যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার গত ১ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, আয় করসীমার ওপরে হোক বা নিচে সবাইকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। আয়কর রিটার্নের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন। এরা দেশের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ! অথচ এই তারাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করেন। কখনো আবার সরকারের অবৈধ, অসাংবিধানিক এবং অন্যায় নির্দেশ ভৃত্যের মতন নত শিরে মেনে নেন। নৈতিকতার এমন স্খলন কোন গণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে, তা বলা কঠিন। এই কারণে দেশ পৃথিবীর কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত।
গত বছর নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমার তারিখ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছিল সরকার। কথা ছিল, সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছরে একবার সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। যদিও এই বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে ব্যর্থ হলে অথবা কোনো ভুল তথ্য প্রদান কিংবা তথ্য গোপন করা হলে বা সম্পদের কোনো অসংগতি পরিলক্ষিত হলে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই হয়নি। এ বিষয়ে সোমবার দেশ রূপান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘দেশব্যাপী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ। তারপরও বিবরণী গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে অসৎ পথে, জনসেবা ব্যাহত করে কারা বিত্তশালী হচ্ছেন, তা নজরদারি করা।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। জানিয়েছেন- ‘সরকার শৃঙ্খলার স্বার্থে এ বিবরণী জমা নেয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিয়মানুযায়ী তাদের সম্পদের বিবরণ দেন। কিন্তু তাতে আয়-ব্যয়ে তারতম্য দেখা গেলে সেটি দেখার তেমন সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেই; এটি কষ্টসাধ্যও বটে।’ এর মানে হচ্ছে, সরকারের কাছে সব তথ্য-উপাত্ত থাকে কিন্তু জনগণকে তা জানানো হয় না। কেন জানানো হয় না, সেটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এক অজানা স্পর্শে, ফাঁদ পেতে, ভিন্ন বিষয় অবতারণা করে আমাদের বেমালুম ভুলিয়ে দেওয়া হয়, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণীর কথা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন যখন বলেন, ‘এটি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রক্রিয়া। অবশ্যই এর প্রয়োজন আছে। এটি দুর্নীতিগ্রস্তদের সতর্ক রাখবে। অনিয়ম পাওয়া গেলে কয়েকজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে বাকিরা সতর্ক থাকবে।’ কিন্তু তা হচ্ছে কি? জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘সম্পদের বিবরণী জমা না দিলে দ-ের কথা সংশ্লিষ্ট আইনে বলা আছে। যত বড়ই হোক, চোরকে চোর বলতে হবে।’ কিন্তু এ পর্যন্ত কতজন চোর দ-িত হয়েছেন, তা আমরা জানি না। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার সময় শুধু বাড়ে। অন্যদিকে তাদের সম্পদের পরিমাণও বাড়তে থাকে। তাহলে কি সেই সম্পদ কর্পূরের মতো উড়ে যায়? কিন্তু আমরা যে দুর্নীতির তীব্র ঘ্রাণ পাই!