রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় নাখোশ যাত্রীরা

  • বাড়তি ভিড়ে ঘটছে চুরির অনেক ঘটনা
  • নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেও কার্যকর নয়
  • যাত্রীদের তল্লাশির ব্যবস্থা করা হয় না
  • এমআরটি পুলিশ তেমন দেখা যায় না 
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০১ এএম

গত ২০ মার্চ ঢাকা ক্লাবে ইফতার করে শাহবাগ মেট্রোরেল স্টেশন থেকে উত্তরার উদ্দেশে যাত্রা করেন কবির হোসেন (ছদ্মনাম)। তখন সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট। বাসায় পৌঁছে তারাবির নামাজ পড়ার ইচ্ছা ছিল তার। মেট্রোতে প্রচণ্ড ভিড়, কেউ নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। কোনো রকমে মেট্রোতে চড়লেন তিনি। মেট্রোরেল যখন উত্তরায় পৌঁছাল, তখন পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন তার টাকা চুরি হয়ে গেছে, মোটা অঙ্কের টাকা। বিষয়টি বুঝলেও তার কিছুই করার নেই যেন। মেট্রোর ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও তাকে সহযোগিতা করার কেউ নেই।

শুধু কবির হোসেন নন, অনেকের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটে। মেট্রোরেলে চুরির ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। ফর্মাল পোশাকে অফিসফেরত বা অফিসগামীর ছদ্মবেশে মেট্রোরেলের ভেতরে ভিড় তৈরি করে চুরির ঘটনায় জড়িত একটি চোরচক্র। যেসব স্টেশনে বাড়তি ভিড় হয়, সেসব স্টেশনকে টার্গেট করে এ চক্র। টিকিট কাটার দীর্ঘ লাইনে, ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণদের ভিড়ে, ট্রেন এলে ওঠানামার ভিড়ে চুরির ঘটনাগুলো ঘটে। দেখে বোঝার উপায় নেই কে চোর আর কে ভালো। মেট্রোরেলে নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় না।

মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে চারটি করে প্রবেশমুখ ও নির্গমন পথ রয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট পুলিশ (এমআরটি পুলিশ)। আনসার এবং মেট্রো কর্তৃপক্ষও রয়েছে। পুরো মেট্রো স্টেশন সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাধীন। তারপরও ঘটছে চুরির ঘটনা।

এ বিষয়ে এমআরটি পুলিশের প্রধান সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এমআরটি পুলিশ মেট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য। মেট্রোতে হুমকি বা বড় কোনো সমস্যা দেখা দিলে এমআরটি পুলিশ কাজ করে। মেট্রোর ভেতরে চুরির ঘটনা ঘটলে সেই চোরদের ধরা তাদের কাজ নয়। তারপরও মেট্রো স্টেশনে চুরি বা অন্য ঘটনা ঘটলে এমআরটি পুলিশ সক্রিয় হয়। প্রতিনিয়ত এ ধরনের আসামিকে আটক করে থানায় দেওয়া হয় বা ভুক্তভোগীকে মামলা করতে সহযোগিতা করে এমআরটি পুলিশ।

তিনি বলেন, মেট্রোরেলের ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় সিসিটিভি ফুটেজে সব রেকর্ডেড থাকে। তবে ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ এমআরটি পুলিশকে দিতে অনীহা প্রকাশ করে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। ফুটেজ না পাওয়ায় সব ঘটনার সমাধান হয় না। স্টেশনের প্রতিটি গেটে দুজন করে এমআরটি পুলিশ কাজ করে। এ সংখ্যা যাত্রীর তুলনায় খুবই কম। মোট এমআরটি পুলিশের সংখ্যা অনেক কম। তাই সব ধরনের নিরাপত্তা এমআরটি পুলিশের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ মেট্রোরেলের তথ্য’ নামে একটি গ্রুপে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মেট্রোরেল থেকে আইফোন ১৫ চুরির ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, কাজীপাড়া স্টেশনে মেট্রোরেলে প্রবেশের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু যাত্রী। ট্রেন এলে একপাশ থেকে যাত্রী নামে, অন্যপাশ থেকে যাত্রী ওঠে। ওই সময় সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজন আইফোন ১৫ চুরি করে নিয়ে যায়।

ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘দেখতে ভদ্রলোক, মাথায় টুপি আবার অফিসের পরিপাটি ড্রেস পরা। কিন্তু লোকটি আইফোন চুরি করেছে।’ একই ভিডিওতে যাত্রীদের সাবধান করার জন্য লেখা হয়েছে, ‘অতিরিক্তি ভিড়ে সাবধানে মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্য জিনিসপত্র রাখবেন।’

জানা গেছে, ইফতারের আগ মুহূর্তে মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভিড় বেড়ে যায়। পরিবারের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিতে হুমড়ি খেয়ে মেট্রোরেলে ওঠার চেষ্টা করেন যাত্রীরা। ওই সময়টিকেই টার্গেট করছে চোরচক্র। যাত্রীবেশে স্টেশনে প্রবেশ করে তারা ফোন ও মানিব্যাগ হাতিয়ে নেয়। ঈদ কেন্দ্র করেও মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশনে ভিড় জমে যায়। তখন চোরচক্র সক্রিয় হয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।

মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় যাত্রীদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি ও স্টেশনের প্রবেশমুখে আর্চওয়ের ব্যবস্থা আগের মতো দেখা যায় না। সার্বক্ষণিক নজরদারি, যাত্রীদের লাগেজ স্ক্যান ও বিস্ফোরকজাতীয় দ্রব্য শনাক্তে যে যন্ত্র মেট্রো স্টেশনে থাকার কথা, তাও এখন দেখা যায় না।

এ বিষয়ে মেট্রোরেলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মেজর মোহাম্মাদ জাকির সিদ্দিকী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এগুলো আসলে ব্যয়বহুল যন্ত্রাংশ। কিছু স্থানে এগুলোর ব্যবহার রয়েছে। তবে সব স্টেশনে যাত্রীদের নিরাপত্তায় এগুলোর প্রয়োজন। আমরা এগুলোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’

গত এক সপ্তাহে দুজন পকেটমারকে আটক করেছে এমআরটি পুলিশ। গত ১১ মার্চ ফার্মগেট স্টেশন থেকে নামার সময় এক যাত্রীর ব্যাগ থেকে মোবাইল চুরি করে এক পকেটমার। টের পেয়ে উপস্থিত যাত্রীরা তাকে আটক করে। পরে এমআরটি পুলিশ তাকে তেজগাঁও টহল পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। গত ১০ মার্চ কারওয়ান বাজার মেট্রো স্টেশন থেকে আরেক পকেটমারকে আটক করে এমআরটি পুলিশ। তাকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত ৬ মার্চ বিকেলে মতিঝিলের মেট্রোরেল স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে এক ব্যক্তির প্রায় ২২ লাখ টাকা (২৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার) চুরির অভিযোগ ওঠে।

ভুক্তভোগী মেজবাহ উদ্দিন এ বিষয়ে মতিঝিল থানায় একটি অভিযোগও করেন। এসব ঘটনার কারণে মেট্রো স্টেশনগুলোয় নজরদারি বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে অতিরিক্ত ভিড় থাকায় ঘটনা ঘটেই চলছে বলে জানায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের সতর্ক থাকতে বলছেন তারা। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত