ফেরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পুরো সন্দ্বীপ থেকে হাজারো মানুষ অনুষ্ঠানে হাজির ছিল। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে এ কারণে সবার চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এটিকে ঈদের আগে ঈদের আনন্দ বলে মতপ্রকাশ করছে। এই দ্বীপের প্রায় চার লাখ মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ছয়টি নৌরুট। তবে সব নৌরুটেই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতেন যাত্রীরা। এ ছাড়া ছিল কাদা মাড়িয়ে হাঁটার দুর্ভোগ। অসুস্থ ব্যক্তি, বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের পারাপারে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতো। পণ্য পরিবহনে পড়তে হতো অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। ফেরি চালু হওয়ায় এখন থেকে এসব দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে এ অঞ্চলের মানুষ। তুলনামূলক অনেক কম খরচে অনায়াসে পণ্য কিংবা যেকোনো গাড়ি সহজে পার করা যাবে।
এ ছাড়া যাতায়াতের অসুবিধার কারণে এ অঞ্চলে এতদিন কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। এখানকার বেশিরভাগ বিত্তশালী চট্টগ্রামের হালিশহর, সীতাকু-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তবে এখন থেকে এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ী নেতারা।
সন্দ্বীপের পৌর সদরের বাসিন্দা জোনায়েত, জাবেদ, সাদ্দাম, রফিকসহ কয়েকজন বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও আমরা কল্পনা করিনি ফেরি কখনো বাস্তবে সন্দ্বীপ নৌপথে চলাচল করবে। আজ স্বচক্ষে দেখার পরও এটিকে আমাদের কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ঈদের আগে আজ আমরা ঈদ আনন্দ উপভোগ করছি। দ্বীপবাসীর জন্য এটা কত বড় পাওয়া সেটা বলে বোঝানো যাবে না।’
সন্দ্বীপ টাউন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বসর বলেন, ‘আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে মালামাল আনতে একবার লালবোটে ওঠানো, লালবোট থেকে আবার জাহাজে বা ট্রলারে ওঠানো, ট্রলার থেকে আবার লালবোটে করে দ্বীপে নামাতে অনেক সময় আমাদের অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে যেত। পণ্য পরিবহনে খরচও অনেক বেশি হয়ে যেত। এই কারণে সন্দ্বীপে পণ্যমূল্য তুলনামূলক অনেক বেশি ছিল। এখন ফেরিতে করে গাড়িসহ আমরা মালামাল পার করতে পারব। এতে আমাদের খরচ অনেক কম হবে। ফলে পণ্যমূল্যও কমে যাবে।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘ সন্দ্বীপের মানুষের আয়ের একটা বড় উৎস প্রবাসী আয়। সারা দেশের রেমিট্যান্সের প্রায় ১২ শতাংশ আসে সন্দ্বীপের প্রবাসীদের কাছ থেকে। কিন্তু যাতায়াত অসুবিধার কারণে সাত সাগর তের নদীর ওপারে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্রবাসীরা এসে সীতাকুন্ডে আটকে থাকে। দ্বীপে পৌঁছাতে না পেরে অনেকে বাবা-মায়ের জানাজা পড়তে পারেনি এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। প্রবাসীরা দ্বীপের বাইরে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি করার প্রবণতায় ছিলেন। এখন থেকে সন্দ্বীপের মানুষ আবার সন্দ্বীপমুখী হবে।’
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা বলেন, ‘এ উপজেলায় মালামাল পারাপারে বিশাল একটা খরচ পড়ে, ফেরি চলাচলে এটি অনেক কমে যাবে। স্পিডবোটের মতো কাদা মাড়িয়ে মানুষকে চলাচল করতে হবে না। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে। নৌপথের ঝুঁকির কারণে এখানে কোনো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। ফেরিতে কারখানার মালামাল ও কাঁচামাল সহজে পরিবহন করতে পারবে। এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সন্দ্বীপবাসীর জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা পুরো দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।’
দেশের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে এক টুকরো বিচ্ছিন্ন জনপদের নাম সন্দীপ। দ্বীপটির বয়স তিন হাজার বছরেরও অধিক বলে জানা যায়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই দ্বীপের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থারও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে ৭৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শতবছর ধরে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নানা দুর্ঘটনা কিংবা দ্বীপবাসীর দাবির মুখেও মূল ভূখ- থেকে দ্বীপে যাতায়াত ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। এখানে যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল স্পিডবোট। এ ছাড়া একটি যাত্রীবাহী জাহাজ অনিয়মিতভাবে চলাচল করত। তবে জাহাজ থেকে নামতে কিংবা জাহাজে উঠতে ব্যবহার করতে হতো ‘লালবোট’ নামের ছোট আকারের নৌকা। লালবোট ডুবে ২০১৭ সালে ১৮ জন প্রাণ হারান। তবুও বন্ধ হয়নি অনিরাপদ স্পিডবোট, লালবোট ও কাঠের তৈরি ট্রলারে যাত্রী পারাপার। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটত দুর্ঘটনা। এবার সন্দ্বীপবাসীর সেই কষ্ট লাঘব হতে চলেছে। সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে এখন থেকে নিয়মিত চলাচল করবে ‘কপোতাক্ষ’ নামের একটি ফেরি। গতকাল ভার্চুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেরির উদ্বোধন করেন।