বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের রাজস্ব আহরণের প্রধান উৎস আয়কর। এটি মূলত প্রত্যক্ষ কর হিসেবে বিবেচিত। এ করকেই সবচেয়ে প্রগতিশীল কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এখানে যে ব্যক্তির আয় যত বেশি, তার ওপর করের আপাতনও তত বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো বহুলাংশে শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এর প্রধান কারণ যারা কর দেওয়ার উপযুক্ত, তারা সঠিকভাবে কর দেন না। বিষয়টি আবারও প্রমাণিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের বক্তব্যে। তিনি জানিয়েছেন, চলতি করবর্ষে অনলাইনে ১৫ লাখ আয়কর রিটার্ন দাখিল হয়েছে, এর মধ্যে ১০ লাখই শূন্য রিটার্ন। অর্থাৎ এই ১০ লাখ রিটার্নের বিপরীতে কোনো রাজস্ব পায়নি সরকার।
দেশে রাজস্ব আহরণের প্রধান প্রতিষ্ঠান এনবিআর। দেশের মোট রাজস্বের ৮০ শতাংশেরও বেশি আহরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। মোটাদাগে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের তিনটি খাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং আয়কর। এ তিনটি উৎসের মধ্যে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট পরোক্ষ কর। এ কর দেশের ধনী-দরিদ্র সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে।
রাষ্ট্রের একটি প্রধান দায়িত্ব দেশের নাগরিকদের মধ্যে আয় বৈষম্য কমিয়ে সবার জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো। সে জন্য ধনিক শ্রেণির ওপর বেশি কর ধার্য করা হয়। আর তাদের থেকে গৃহীত করের অর্থে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য নানা ধরনের আয়বর্ধনমূলক ও উন্নয়নমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। একটি আদর্শ কর ব্যবস্থায় তেমনটি হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে উল্টো রথ পরিলক্ষিত হয়। এখানে কোনোভাবেই প্রত্যক্ষ কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে। যার প্রতিফল দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপের (হেইস) তথ্যে।
গতকাল সোমবার সকালে আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনার আয়োজন করে এনবিআর। এতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানান, চলতি করবর্ষে অনলাইন রিটার্নের মধ্যে ৬৬ শতাংশই শূন্য রিটার্ন। তিনি বলেন, ‘১৫ লাখ অনলাইন রিটার্নের ১০ লাখই সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে। তার মানে আমরা সঠিক করদাতাদের ধরতে পারছি না।‘ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়। অর্থাৎ ১০ লাখ করদাতা তাদের আয়কর বিবরণীতে যে বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন তার বিপরীতে কোনো কর দিতে হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্য বড় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এর কারণ হচ্ছে আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ আমদানির ওপর যে হারে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক আরোপ করে সেটি আর করতে পারবে না। বিশেষ করে সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার পক্ষ থেকে নানা বিধিনিষেধ আসবে। ফলে আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব আহরণ হ্রাস পাবে। সম্মিলিতভাবে এখনো এ দুটি খাতই রাজস্বের সবচেয়ে বড় খাত। কাজেই দেশের বিদ্যমান পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহের জন্য নাগরিকদের থেকে আয়কর আহরণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার বিধান বাধ্যতামূলক করেছে। যে কারণে অনেকেই প্রয়োজনের তাগিদে রিটার্ন দাখিল করছে। যাদের অনেকেরই করযোগ্য আয় নেই। এটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে যাদের অনেক বেশি করযোগ্য আয় রয়েছে, তারা সঠিকভাবে কর দিচ্ছে কি না, সে বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে করদাতারা তাদের আয়ের তথ্য যাতে গোপন করতে না পারে, সে জন্য রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় বিধান সংযুক্ত করতে হবে।’
ভারতের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশটিতে কোনো ব্যক্তি চাইলেই বড় কোনো সম্পদ কিনতে পারে না। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো তাদের রয়েছে আধার কার্ড। এই কার্ডের সঙ্গে নাগরিকদের সব মৌলিক তথ্য সংযুক্ত। কাজেই কোনো ব্যক্তি যদি বড় কোনো সম্পদ কিনতে যায়, তাহলে আধার কার্ডের মাধ্যমে তার বিস্তারিত তথ্য সরকার জানতে পারে এবং তার কাছ থেকে প্রাপ্য কর আদায় করতে পারে। বাংলাদেশেও তেমন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
এদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাস (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শেষে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি পিছিয়ে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আলোচ্য আট মাসের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ২৪২০ কোটি টাকা। ওই একই সময়ে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মধ্যপথে এসে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করা হয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা; গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ আদায় কমেছে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ কম। স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ও আবগারি শুল্ক খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ। অন্যদিকে আয়কর ও ভ্রমণ খাতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আদায় হয়েছে ৭৩ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা; যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৭০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এ হিসাবে আদায় বেড়েছে ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে, তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারছে না। আর আয়কর খাত থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় আয়কর জরিপ পরিচালনা ও গবেষণা পরিচালনার মতো উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আবার আয়কর খাত থেকে যে রাজস্ব আহরণ হয়, তার বড় অংশই আসে উৎসে কর্তনের মাধ্যমে। রিটার্ন দাখিলের মাধ্যমে যে কর আসে তা এনবিআরের আদায় করা মোট রাজস্বের পাঁচ শতাংশেরও কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে যথাযথভাবে কর সংগ্রহে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তারা মনে করেন।