সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মুসলিম বিশ্বের অবস্থান

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ০১:৪৭ এএম

ইসরায়েল রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক, বর্বর ও নির্মম হিসেবে খ্যাত। ফিলিস্তিনে তাদের বর্বর সন্ত্রাসী হামলায় ৫০ হাজারের বেশি নিরীহ মুসলমান শহীদ হয়েছেন। মানবতা চরমভাবে বিপর্যস্ত। যদিও ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম একটি দীর্ঘস্থায়ী ও কঠিন প্রক্রিয়া। তবু মুসলিম বিশ্বের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সম্ভব। এ জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রয়োজন, যা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে বাস্তবায়িত হতে পারে। তাই প্রথমত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য এককভাবে কোনো দেশ বা শক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। তাই আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে একজোট হয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদান করতে হবে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে শক্তিশালী রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ ছাড়া মুসলিম দেশগুলোকে একযোগে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ইসরায়েল তার অবৈধ দখলদারি বন্ধ করতে বাধ্য হবে।

আন্তর্জাতিক বিষয়ে পিএইচডি হোল্ডার ইবরাহিম কারাতাস ডেইলি সাবাহকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। গাজার বিষয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর অবস্থান অত্যন্ত নিষ্ক্রিয়। তারা কেবল ইসরায়েলের চলমান হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করছে, যদিও তারা ভালো করেই জানে যে, শুধু নিন্দা জানানো যথেষ্ট নয়। এই নিন্দা তাদের নিষ্ক্রিয়তার লজ্জা ঢাকার কৌশল মাত্র।’ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর মুসলিম স্কলারের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত আছেন আলী মুহিউদ্দিন আল-কারাদাগি। আনাদোলু এজেন্সির এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামি বিশ্ব তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাই সম্মিলিতভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় ইসলামি বিশ্ব তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রথম দল নীরব থেকেছে, যেন এই গণহত্যা ও হামলাগুলো কখনো ঘটেনি। দ্বিতীয় দল কেবল নীরব থাকেনি, বরং ইসরায়েলকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে। তৃতীয় দল হলো তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া ও কুয়েতের মতো স্বল্পসংখ্যক দেশ, যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি ইসরায়েলকে থামানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। গণহত্যা, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। তারা আমাদের জমি ও ঘরবাড়ি দখল করে নিয়েছে। এই বছর প্রকৃত অর্থে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। অবকাঠামো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইতিহাস কখনো এমন ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেনি। এই ঘটনাগুলো মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। ৫০টিরও বেশি ইসলামি দেশ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’ আলজাজিরার বরাতে জানা যায়, গত বছর বাহরাইন ঘোষণা দিয়েছিল, ‘জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হবে, যা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করবে দ্বিরাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিতে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের দখলকৃত সব আরব ভূমি মুক্ত করা হবে এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা আন্তর্জাতিক বৈধতা সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ অনুসারে শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে ইসরায়েলের পাশাপাশি বসবাস করবে। এটিই ন্যায়সঙ্গত ও পূর্ণাঙ্গ শান্তি অর্জনের উপায়।’ যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরকার দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, কিন্তু বাস্তবে এটির বিরোধিতা করে আসছে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ দেওয়ার বিরুদ্ধে একমাত্র ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা একটি সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ প্রতিরোধ করবে। কিন্তু এই বাধাও প্রতিহত করা সম্ভব, যদি আরব দেশগুলো শক্তিশালী ঐক্যের মাধ্যমে এক প্ল্যাটফর্মে আসে। দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য বিশ্ব সম্মেলন আয়োজিত হলে আশা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান পাল্টাবে। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক ভূমিকা এবং বিশ্বশক্তি ব্যবস্থায় প্রভাব রাখতে গেলে আরব বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক দরকার। বৃহত্তর ইসলামি বিশ্ব ও বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে।

অবশ্য ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব ঐক্য ভাঙতে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি করতে চাইছে, এমন খবর একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। আরও জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে পারমাণবিক প্রযুক্তি, উন্নত যুদ্ধবিমান ও প্রতিরক্ষা চুক্তির নিশ্চয়তা দিবে, যদি সৌদি আরব অবিলম্বে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে না গিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে আবারও একটি অনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার অধীনে ছেড়ে দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং সৌদিসহ আরব দেশগুলো এখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব এবং তারা ফিলিস্তিনের মুক্তিতে কাজ অব্যাহত রেখেছে।

সুতরাং আরব বিশ্ব যদি এমন দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থানে থাকে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাধাগ্রস্ত করা বন্ধ করতে হবে, তাহলে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের আত্মপ্রকাশ শিগগিরই হবে, এটাই মুসলিম বিশ্বের ইচ্ছা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত