মঙ্গলবার শেষ হয়েছে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ ২০২৪-২৫ এর ৮ম রাউন্ডের খেলা। ১২ দলের এই আসরের ৪৮টি ম্যাচ সমাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২টি ম্যাচ বৈরী আবহাওয়ার কারণে কোনো বল মাঠে না গড়িয়েই পরিত্যক্ত হয়েছে, ফল এসেছে বাকি ৪৬টি ম্যাচেই। ১৭৫ রানের বড় ব্যবধানে জয় যেমন দেখা গেছে, তেমনি ১ উইকেটে শেষ বলে নিষ্পত্তি হওয়া ম্যাচও দেখা গেছে। তবে ফল নিষ্পত্তি হওয়া ৪৬টা ম্যাচের বেশিরভাগই হয়েছে একতরফা। দলগুলোর শক্তিমত্তার বড় ব্যবধান, গরম, রোজা সব কিছু মিলিয়েই এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মান নিম্নমুখী। দেশের শীর্ষ ওয়ানডে প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ কমে আসার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিম্নগামী হওয়ার যোগসূত্র দেখছেন অনেকেই।
উজ্জ্বল নাঈম, ধারাবাহিক এনামুল
ঢাকা লিগে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ইনিংসটা এসেছে মোহাম্মদ নাঈমের ব্যাট থেকে। প্রাইম ব্যাংকের হয়ে খেলা এই বামহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান নাঈম ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে খেলেছেন ১৭৬ রানের ইনিংস। এছাড়াও শাইনপুকুরের বিপক্ষে নাঈমের একটি ১০৪* রানের ইনিংস আছে মাত্র ৬৪ বলে। ৮ ইনিংসে নাঈমের রান ৪৯১, দুটো সেঞ্চুরি আর একটি হাফসেঞ্চুরি। এনসিএল টি-টোয়েন্টি এবং বিপিএলের পর ঢাকা লিগেও নিয়মিত রান করছেন নাঈম, তার ব্যাটিংয়েও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়া নাঈম ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখতে পারলে ফের জায়গা পেতে পারেন জাতীয় দলে। লিগে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এনামুল হক বিজয়। ৮ ম্যাচের ৮ ইনিংসে এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের রান ৫৩০। ২০২২ সালের ঢাকা লিগের মৌসুমে রেকর্ড গড়ে ১০৪২ রান করেছিলেন এনামুল, যে কীর্তি তাকে ফিরিয়েছিল জাতীয় দলেও। কিন্তু ঘরোয়ার পারফরম্যান্স জাতীয় দলের হয়ে করে দেখাতে পারেননি এনামুল, তাই আবারও তিনি বাইরে। এমনকি কেন্দ্রীয় চুক্তিতেও নেই।
গরমে কাহিল ক্রিকেটাররা
বাংলা চৈত্র আর আরবি রমজান, এই দুই মাসের মেলবন্ধন হওয়া মানেই দুর্বিষহ পরিস্থিতি। প্রকৃতিতে উত্তাপ ওদিকে সিয়াম সাধনার মাস তাই দিনের বেলায় পানাহার নিষিদ্ধ। ক্রিকেটারদের অনেকেই ঢাকা লিগের ম্যাচ খেলছেন রোজা রেখে। তাই মাঠের পারফরম্যান্সে ভাটার টান। রোদে গরমে ৫০ ওভার ফিল্ডিং করা, ব্যাটিং কিংবা বোলিং সবই শুষে নেয় প্রাণশক্তি। এই সময়টায় লিগ আয়োজনে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা পাওয়া যায় না, তবুও টানা কয়েক মৌসুম ধরেই এই সময়েই হয়ে আসছে ঢাকা লিগ। তাই জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের পাওয়া যায় লিগের বড় একটা অংশ জুড়ে। ক্লাবগুলোও জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ছাড়া খেলতে অনিচ্ছুক। সব কিছুর যোগফল বাংলাদেশেও ক্রিকেটের ‘সামার স্পোর্ট’ বনে যাওয়া!
জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা নিষ্প্রভ
৮ রাউন্ডের খেলা শেষে কিছুদিন আগেই খেলে আসা আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বাংলাদেশ দলের মাত্র ২ জন সদস্যকে সেঞ্চুরি করতে দেখা গেল ঢাকা লিগে। একজন নাজমুল হোসেন শান্ত, অন্যজন মেহেদী হাসান মিরাজ। স্কোয়াডে থাকা পারভেজ হোসেন ইমন একটা সেঞ্চুরি করেছেন, যদিও ইমনের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলা হয়নি। আইসিসি ইভেন্টের দুটো ম্যাচেই বাংলাদেশের ব্যাটিং সামর্থ্যরে দৈন্য দশা চোখে পড়েছে। ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে রান পাচ্ছে না বাংলাদেশ। একই অবস্থা জাতীয় লিগেও। বছর জুড়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে, বিদেশি কোচিং স্টাফের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে, বিসিবি’র সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত ক্রিকেটাররা ঘরোয়া লিগের প্রথম ৮ ম্যাচে মনে রাখার মতো কিছু করে দেখাতে পারেননি। বরং কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া পেসার তাসকিন আহমেদ এক ম্যাচে ১০৭ রান দিয়ে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সবচেয়ে খরুচে বোলার হয়ে গেছেন। অবসরে যাওয়া তামিম ইকবালও যে আসরে দুটো শতরান করেন সেখানে তাওহীদ হৃদয়, জাকের আলি অনিক, তানজিদ হাসান তামিমদের পারফরম্যান্স নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি।
সেই বামহাতি স্পিনারদের রাজত্ব
বাংলাদেশ দলে বামহাতি স্পিনারদের রাজত্ব ফুরিয়ে গেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে বামহাতি স্পিনার নির্ভরতা এখনো কমেনি। ক্লাবের কোচেরা হাঁটেন চেনা সূত্রেই। বামহাতি স্পিনারদের হাতে বল তুলে দেন ধীরগতির উইকেটে। গরমে পেসাররা কাহিল, অগত্যা স্পিনই ভরসা। ৮ রাউন্ড শেষে শীর্ষ ৩ উইকেট শিকারিই বামহাতি স্পিনার। সবার ওপরে ১৭ উইকেট নেওয়া রাকিবুল হাসান, তার পরের জায়গায় তাইজুল ইসলাম আছেন ১৬ উইকেট নিয়ে আর ১৪ উইকেট নিয়ে আরাফাত সানি আছেন তিনে। ধারাভাষ্যকার মাজহার উদ্দিন মিরপুরে হয়ে যাওয়া ৮টা ম্যাচই দেখেছেন, ধারাভাষ্য দিয়েছেন। তার কাছে মনে হয়েছে বোলাররা যতটা না উইকেট পেয়েছেন, এর চেয়ে ব্যাটসম্যানরাই উইকেট দিয়ে এসেছেন বেশি। গেম সেন্সের অভাব, শট নির্বাচনে ভুল এবং প্রস্তুতির ঘাটতি; সব মিলিয়েই ব্যাটসম্যানদের মান নিম্নগামী। ফলে বড় দলীয় সংগ্রহ যেমন দেখা যাচ্ছে না, তেমনি বোলাররাও উইকেট পাচ্ছেন অপেক্ষাকৃত সহজে।
বড় রান করার অভ্যাস নেই
বড় দলীয় ইনিংসও হচ্ছে কম। প্রাইম ব্যাংক এক ম্যাচে ব্রাদার্সের বিপক্ষে ৪২২ রান করলেও সেটা ৯২টি দলীয় ইনিংসের একটি মাত্র। ৩০০ রানের বেশি হয়েছে মাত্র ৯ ইনিংসে। দলীয় ১০০ রানের নিচে অলআউট হওয়ার ঘটনা ৩টি, ১০০ থেকে ২০০ রানের ভেতর অলআউট হওয়ার ঘটনা ১৭টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রস্তুতিপর্বে যদি ব্যাটসম্যানরা এত কমে অলআউট হয়ে যান তাহলে স্পষ্টই বোঝা যায় তাদের ব্যাটিং সামর্থ্যরে ঘাটতিটা।